সর্ববর্ণে দশাশৌচ

আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন স্মৃতি-শাস্ত্র ‘মনু-সংহিতা’-য় মনু লিখেছেন, -
“দশাহং শাবমাশৌচং সপিণ্ডেষু বিধীয়তে ।
অর্বাক্ সঞ্চয়েনাদস্থাং ত্রহেমেকাহমেব চ ।।”
- (৫/৫৯)
অর্থাৎ সপিণ্ডের মৃত্যু হলে দশাহ (দশদিন) অশৌচ হবে এবং গুণের তারতম্য অনুসারে চারদিন অথবা তিনদিন বা এক অহোরাত্র মাত্র অশৌচ বিহিত ।
এর পরের শ্লোকে মনু বলেছেন, - ‘অশৌচের দিনসংখ্যা কোনভাবেই বৃদ্ধি করা যাবে না ।’
“বরাহ পুরাণে” উক্ত হয়েছে,-
“দশাহং সাবমাশৌচং সপিণ্ডেষু বিধীয়তে ।
জননেহপ্যেমেব সান্নিপুণং শুদ্ধিমিচ্ছতাম্ ।।”
- (১৮৮ এবং মনু-সংহিতা - ৫/৬১)
অর্থাৎ সপিণ্ডের মৃত্যু হলে দশাহ (দশদিন) অশৌচ হবে এবং যারা নিপুণভাবে শুদ্ধ হতে ইচ্ছা করেন, তারা জননাশৌচেও দশদিন অশৌচ পালন করবেন । 
উক্ত পুরাণের একই স্থানে বলা হয়েছে, ‘মনুষ্যগণের মধ্যে বিপ্র, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য বা শূদ্র এই চারিবর্ণেরই একোদ্দিষ্ট বিধি একরূপ ।’
‘কুর্ম্মপুরাণে’-র উপরিভাগে ২৩নং অধ্যায়ে বলা আছে, ‘একাদশ দিবসে বা দ্বাদশ দিবসে অথবা নবম দিবসে প্রেতকে উদ্দেশ্ করে শ্রাদ্ধ করবে ।’
‘গরুড়পুরাণে’-র উত্তরখণ্ডে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গরুড়ের প্রশ্নের উত্তরে বলছেন, -
‘ভবেয়ুর্দশরাত্রং বৈ যত আশৌচনং খগ ।’
- (৬/৩)
হে খগ ! পুত্রাদি সপিণ্ডবর্গের দশরাত্র অশৌচ পালনীয় ।’
উক্ত পুরাণের একই অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে বলেছেন, ‘সপিণ্ডদিগের মরণাশৌচ দশাহ ; যারা নিপুণভাবে শুদ্ধি আকাঙ্খা করেন, তারা পুত্রাদিজননেও দশাহ অশৌচই পালন করেন ।’
উক্ত পুরাণের একই অধ্যায়ের ৪৬নং শ্লোকে বলেছেন,-
“যদিষ্টং জীবতস্তস্য দদ্যাদেকাদশেহহনি ।”
অর্থাৎ মৃতব্যক্তির যা যা প্রিয় ছিল, একাদশ দিনে সেই সেই দ্রব্য দান  করবে ।
উক্ত পুরাণের এক্ই অধ্যায়ের ৫১নং শ্লোকে বলেছেন, -
“একাদশে দ্বাদশে বা দিন আদ্যং প্রকীর্ত্তিতম্ ।”
অর্থাৎ একাদশ বা দ্বাদশ দিন আদ্য শ্রাদ্ধের দিন ।
‘নারদ-সংহিতা’-র ২৯নং অধ্যায়ে বলা হয়েছে, - ‘দশ দিন অতীত হলে একাদশ দিনে অধিবাস মহোৎসব ভোগরাগ ভাগবৎ পাঠ বৈষ্ণব সেবা সাধ্যানুসারে করবেন এবং ঐ মহাপ্রসাদ দ্বারা অর্থাৎ প্রসাদী নির্মাল্য প্রভৃতি দ্বারা্ কেবল মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে পূজাদি করে ঐ মহাপ্রসাদ চরণামৃত প্রভৃতি প্রদান করবেন এবং প্রসাদী বস্ত্রাদিও প্রদান করবেন ।’
এই সকল শাস্ত্রোক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খানুরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে ১৯৭৫ইং সনের ৬ই এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সারাদেশের সকল পণ্ডিতবর্গ মিলিত হয়ে বিশ্ব-বরেণ্য দার্শনিক পরাবিদ্যাচার্য ভাগবত-গঙ্গোত্তরী মানব ধর্মের উদ্গাতা ভারত-শিরোমলি মহামহোপাধ্যায় বৈশ্ণবকুল মুকুটমণি শ্রীমন্ ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মহারাজের পৌরহিত্যে সর্বসম্মতিক্রমে ‘সর্ববর্ণে দশাশৌচ প্রবর্তন’ প্রস্তাবটি গৃহীত হয় । তারপর একই ধারা অনুসরণ করে ১৯৮৬ইং সনের ১৬ই জুন শ্রীহট্টে নিম্বার্ক আশ্রমে অধ্যক্ষ কৃষ্ণ কুমার পাল চৌধুরী এবং শ্রীল নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী মহোদয়ের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে, ১৯৯১ইং সনের ১২ ও ১৩ই ফেব্রূয়ারী সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথধামে বাংলাদেশ সন্ত মহামণ্ডলের সম্মেলনে, ২০০৩ইং সনের ২৬শে জানুয়ারী হবিগঞ্জ জিলার চুনারুঘাটে বাসুদেব-বাড়িতে শ্রীল রাধাবিনোদ মিশ্র, শ্রীমৎ স্বামী শম্ভুনাথানন্দ গিরি মহারাজ-এর উপস্থিতিতে অধ্যক্ষ নিখিল রঞ্জন ভট্টাচার্য মহোদয়ের পৌরহিত্যে অনুষ্ঠিত সিলেট বিভাগীয় গীতা-সম্মেলনে এবং ২০০৪ইং সনের ১৯শে নভেম্বর মৌলভীবাজার জিলার শ্রীমঙ্গলে শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবজীউর আখড়া প্রাঙ্গনে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি উপজেলা থেকে আগত পণ্ডিতমণ্ডলীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সনাতন ধর্ম মহাসম্মেলনে ‘সর্ববর্ণে দশাশৌচ প্রবর্তন’ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা শেষে উক্ত প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত ও গৃহীত হয় ।
জননাশৌচ বা মরণাশৌচ প্রসঙ্গে মনু-সংহিতা বলেছেন, ‘জননাশৌচে পিতা সদ্যঃ স্ননান্তে শুচি হন । মাতা দশদিন পর আপনা-আপনিই শুচি হয়ে যান । এই অশৌচ জ্ঞাতি-কুটুম্বকে স্পর্শ করে না ।’ (৫-৬২)
মনু আরও বলেছেন, ‘দশ দিন ধরে অশৌচ চলাকালে যদি আবার কোনও জন্ম ও মরণজনিত অশৌচ হয়, তবে সেক্ষেত্রে অশৌচের দিন বাড়বে না, প্রথম অশৌচের সাথে সাথেই দ্বিতীয় অশৌচ শেষ হয় । (৫/৭৩-৭৯)
গরুড় পুরাণের পূর্ব খণ্ডে বলা হয়েছে, ‘সপিণ্ডাদি ভেদে ত্রিরাত্র কিংবা দশরাত অশৌচ হয় অর্থাৎ সপিণ্ডের দশরাত্র ও অন্যের ত্রিরাত্র অশৌচ হবে । দুই বৎসর বয়সের মধ্যে পুত্র অথবা কন্যার মরণ হলে কেবল মাতার অশৌচ থাকবে, অন্যের সদ্যঃশৌচ জানবে । প্রথমাশৌচের মধ্যে দ্বিতীয় অশৌচ সম্ভব হলে প্রথমাশৌচের অবশিষ্ট দিনে অশৌচনিবৃত্তি হয়ে থাকে ।’ (১০৬/১৮)
একই পুরাণের একই খণ্ডে বলা হয়েছে, ‘সুতকাশৌচ হলে দশ দিন পর মাতা আর পিতা স্নানমা্ত্রে শুদ্ধ হবেন  । ‘বিবাহ, যজ্ঞ ও উৎসবের সময় যদি মরণাশৌচ বা জননাশৌচ হয়, তবে পূর্সঙ্কল্পিত ভিন্ন অন্য কার্য পরিত্যাগ করিবে । যদি সন্তান জন্মাবার পর অশৌচের মধ্যে মৃত্যুমুখে পতিত হয়, তাহলে প্রসুতি সেই মরণ দ্বারাই উভয় অশৌচ হতে শুদ্ধিলাভ করেন । একটি মরণাশৌচের মধ্যে অন্য  মরণাশৌচ হলে পূর্ব্বাশৌচের সাথে শেষোক্ত অশৌচ অপনীত হয় ।’ (১০৭/১৯)
অতএব উপরোক্ত শাস্ত্রবাক্যসমূহ অনুসারে ‘সর্ববর্ণে দশাহ অশৌচ পালন’, ‘জাতকাশৌচে শুধু মাতার দশাহ পালন’ এবং ‘প্রথমাশৌচের সাথে দ্বিতীয়াশৌচের নিবৃত্তি’ সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে শাস্ত্রীয় কোনরূপ বাধা-নিষেধ নেই ।

Comments

  1. এই লেখাগুলো যে উদ্দেশ্য প্রনীত, তা বিভিন্ন শাস্ত্র অধ্যায়ন করলেই বুঝা যায়। তাই আমার অনুরোধ শাস্ত্র বিরুদ্ধ আলোচনা প্রচার থেকে বেরিয়ে আসুন তাতেই সমাজের মঙ্গল হবে।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

শ্রাদ্ধ-বাসরে প্রধান আরাধ্য-দেবতার বর্ণনাসহ শ্রাদ্ধ-বাসরে ব্রহ্ম-ভুজ্যি/ভুরি ভোজনের ব্যাখ্যা, নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গে - ৩