শ্রাদ্ধ-বাসরে প্রধান আরাধ্য-দেবতার বর্ণনাসহ শ্রাদ্ধ-বাসরে ব্রহ্ম-ভুজ্যি/ভুরি ভোজনের ব্যাখ্যা, নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গে - ২
(পূর্ববর্তী অংশের পর)
শাস্ত্রাচার-বর্জিত পংক্তিদূষণ পরিবেত্তা প্রভৃতি এবং অপরাপর চৌরাদি দ্বিজগণ কর্তৃক যে হব্য-কব্য ভুক্ত হয়, তাহা রাক্ষসেরা ভোজন করে । জ্যেষ্ঠভ্রাতা অনগ্নিক বা অবিবাহিত থাকতে যে কনিষ্ঠ অগ্রে বিবাহ বা অগ্নি স্বীকার করে, সেই কনিষ্ঠ ভ্রাতাকে পরিবেত্তা ও সেই জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে পরিবিত্তি বলে । পরিবিত্তি, পরিবেত্তা, পরিবেদনীয়া কন্যা, কন্যাসম্প্রদানকর্তা ও ঐ বিবাহে পুরোহিত এই পাঁচজন সকলেই নরক প্রাপ্ত হয় । পুত্রোৎপাদনার্থ ধর্মতঃ নিযুক্ত মৃতভ্রাতৃ-পত্নীতে যে ব্যক্তি নিয়োগধর্ম অতিক্রম করে কামবশতঃ আসক্ত হয়, তাহাকে বিধিষুপতি বলে । (স্মৃত্যন্তরে পর-পূর্বার পতিকে বিধিষুপতি বলেছেন) । পরদার গমনে যে দুই প্রকার সন্তান হয়, তাদেরকে কুণ্ড ও গোলক বলে । তন্মধ্যে পতি জীবিত থাকতে তাহার স্ত্রীতে অপরকর্ত্যক যে সন্তান উৎপাদিত হয়, তাহাকে কুণ্ড ও পতি মৃত হলে তাহার স্ত্রীতে যে সন্তান উৎপন্ন হয়, তাহাকে গোলক বলে । পরক্ষেত্রে উৎপন্ন কুণ্ড ও গোলক এই দুইটি প্রাণীকে যে হব্য-কব্য প্রদান করা যায়, তাহাতে দাতার কি ইহলোকে কি পরলোকে, কুত্রাপি কোন ফল জন্মে না । অপাংক্তেয় লোকেরা পংক্তি ভোজনে যতগুলি ব্রাহ্মণকে ভোজন করতে দেখে, অজ্ঞ দাতা ততগুলি ব্রাহ্মণ ভোজনের ফল পান না । অন্ধ ব্যক্তি যদি পংক্তিভোজন দর্শনের উপযুক্ত স্থানে উপবেশন করে, তাহা হলে কর্মকর্তার নবতিসংখ্যক ব্রাহ্মণভোজনের ফল নষ্ট হয়, কাণা যদি এরূপ করে, তবে ষষ্ঠি ব্রাহ্মণভোজনের ফল, শ্বিত্ররোগী শত-ব্রাহ্মণভোজনের ফল ও পাপরোগী এরূপ উপবেশন করলে সহস্র ব্রাহ্মণ-ভোজনের ফল নষ্ট করে । শূদ্রযাজী ব্রাহ্মণ যে যে পংক্তিতে উপবেশন করে, সেই সেই পংক্তিগত শ্রাদ্ধীয় ব্রাহ্মণ-ভোজনের ফল হতে দাতা বঞ্চিত থাকেন । ব্রাহ্মণ বেদবিৎ হলেও যদি লোভবশতঃ শূদ্রযাজীর নিকট প্রতিগ্রহ করেন, অপক্ক শরাবাদিপাত্রে জল প্রবেশ করলে তাহা যেমন শীঘ্র নষ্ট হয়ে যায়, তদ্রূপ তিনিও শীঘ্র নষ্ট হয়ে থাকেন । সোমলতা-বিক্রেতাকে যাহা দান করা যায়, তাহা বিষ্ঠাবৎ অর্থাৎ দেব-পিতৃর ত্যাজ্য ; চিকিৎসা-ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণকে যাহা দেওয়া যায়, তাহা পূয ও শোণিতবৎ ত্যাজ্য, দেবল ব্রাহ্মণকে যাহা দান করা যায়, তাহা নিস্ফল এব্ং বৃদ্ধিজীবীকে যাহা দেওয়া যায়, তাহা দেবাদি-সমীপে স্থানলাভই করতে পারে না । বণিকবৃত্তিজীবী বা পৌণর্ভব দ্বিজকে যে হব্য-কব্য দান করা যায়, ইহলোকে বা পরলোকে তাহার কোন ফল হয় না । উহা ভস্মাহুতির ন্যায় নিস্ফল হয়ে যায় । পূর্ব পূর্ব কথিত অসাধু ও অপরাপর অপাংক্তেয় ব্রাহ্মণকে যে হব্য-কব্য প্রদান করা যায়, পণ্ডিতেরা বলেন যে, তাহা মেদ, মাংস, রক্ত, মজ্জা ও অস্থিস্বরূপ । (৩/১৭০-১৮২)
সমুদয় বেদে যাঁহারা অগ্রগণ্য, সমুদয় বেদাঙ্গেও যাঁহারা সমধিক ব্যুৎপন্ন এবং দশপুরুষ পর্যন্ত যাঁহাদের বংশে বেদাধ্যয়নের বিশ্রাম নেই, সেই ব্রাহ্মণগণকেই পংক্তিপাবন বলে জানবে । যজুর্বেদের প্রখ্যাত ভাগ ত্রিণাচিকেত যিনি বতেসহকারে অবলম্বন করেছেন, যিনি পঞ্চাগ্নিবিশিষ্ট প্রখ্যাত ত্রিসুপর্ণ যিনি ব্রতসহকারে গ্রহণ করেছেন, ছয়টি বেদাঙ্গে যাঁহার বিশেষ ব্যুৎপত্তি, যিনি ব্রাহ্ম-বিবাহে বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভজাত এবং যিনি জ্যেষ্ঠ সাম অর্থাৎ সাম-বেদের আরণ্যক গান করে থাকেন, এই ছয়জন সকলেই পংক্তিপাবন ব্রাহ্মণ । বেদার্থের বেত্তা, বেদার্থের প্রবক্তা, ব্রহ্মচারী, বহুদানশীল, শত বর্ষায়ুস্ক ব্রাহ্মণ - এরা সকলেই পংক্তিপাবন বলে জানবে । শ্রাদ্ধকর্ম উপস্থিত হলে তাহার পূর্বদিনে অথবা শ্রাদ্ধ-দিনে ন্যুন সংখ্যায় অন্ততঃ তিনটি পূর্বকথিত ব্রাহ্মণকে যথোচিত সম্মান-সহকারে নিমন্ত্রণ করবে । ব্রাহ্মণ, - শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রিত হলে নিমন্ত্রণের দিন হতে শ্রাদ্ধাহোরাত্র যাবৎ স্ত্রী-নিবৃত্তি ও যথানিয়ম-অনুষ্ঠানবান হবেন এবং জপাদি সন্ধ্যোপাসনা ব্যতীত বেদ অধ্যয়ন করবেন না । যিনি শ্রাদ্ধকর্তা, তাকেও এরূপ নিয়ম অবলম্বন করতে হবে । সেই নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণ-শরীরে পিতৃগণ অদৃশ্যরূপে অনুপ্রবেশ করেন । তাঁরা যথায় গমন করেন, বায়ুপ্রমাণ পিতৃগণ তাঁদের অনুগমন করেন এবং তাঁরা আসীন হলে পিতৃগণ উপবিষ্ট হন । দৈব ও পিতৃকার্যে যথাশাস্ত্র নিমন্ত্রিত হয়ে ব্রাহ্মণ যদি কোনক্রমে তার অতিক্রম করেন অর্থাৎ শ্রাদ্ধ ভোজন না করেন অথবা ব্রহ্মচর্যাদি নিয়মবান না হন, তাহলে সেই পাপে তাঁর শোকর-যোনি প্রাপ্ত হয় । যে ব্রাহ্মণ শ্রাদ্ধে আমন্ত্রিত হয়ে মোহবশতঃ বৃষলী-স্ত্রী-সম্ভোগাদি করেন, শ্রাদ্ধকর্তার যে কিছু পাপ আছে, সে সমুদায় তাঁতে সংক্রমিত হয় । পিতৃগণ ক্রোধশূণ্য, শৌচপরায়ণ এবং সর্বদা ব্রহ্মচারীভাবে অবস্থিত ; তাঁরা শস্ত্রত্যাগী, ঔদার্যাদি-গুণযুক্ত, মহাত্মা এবং তাঁরা দেবতাদেরও পূর্বতন ; তাঁদের উপাসনা করতে গেলে তদ্ধর্মী হওয়া, শ্রাদ্ধকর্তা ও শ্রাদ্ধভোক্তা উভয়েরই আবশ্যক । (৩/১৮৪-১৯২)
শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তম স্কন্ধের পঞ্চদশ অধ্যায়ে নারদ মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, হে রাজন্, কতকগুলি ব্রাহ্মণ কর্মনিষ্ঠ এবং কতকগুলি ব্রাহ্মণ জ্ঞাননিষ্ঠ । অপর ব্রাহ্মণেরা বেদপাঠে নিরত । অন্য বিপ্রগণ বেদব্যাখ্যায় নিরত । আবার কিছু ব্রাহ্মণ জ্ঞান ও যোগনিষ্ঠ । যে ব্যক্তি দানের অনন্ত ফল ইচ্ছা করেন, তিনি জ্ঞাননিষ্ঠ বিপ্রকে কব্য অর্থাৎ পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে দেয় দ্রব্য এবং হব্য অর্থাৎ দেবলোকের উদ্দেশ্যে দেয় দ্রব্য দান করবেন । যদি তেমন ব্রাহ্মণ না পওেয়া যায়, তবে যোগ্যতানুসারে অপর ব্রাহ্মণকে দেবেন । দৈবে দুইটি ব্রাহ্মণ এবং পিতৃপক্ষে তিনটি ব্রাহ্মণকে ভোজন করাবে । অথবা দুই পক্ষেই এক একটি করে দুটি ব্রাহ্মণকে ভোজন করাবে । সুসমৃদ্ধ ব্যক্তিও ঐ সংখ্যক ব্রাহ্মণকেই ভোজন করাবে । শ্রাদ্ধে বহু ব্রাহ্মণ ভোজন করাবে না । হে রাজন্, স্বজনকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়ে তার অনুরোধে বিস্তর ব্রাহ্মণকে বললে দেশকালের অনুরূপ শ্রদ্ধা, দ্রব্য, সৎপাত্র এবং অর্চন এ সকল প্রায় উত্তম হতে পারে না । উপযুক্ত দেশকাল প্রাপ্ত হলে বিষ্ণুদৈবত নীবার ধান্যাদি যদি শ্রদ্ধাসহকারে বিধিবৎ সৎপাত্রে দেওয়া যায়, তবে ঐ সকল দান কাম ফলদায়ক ও অক্ষয় হয় । দেবতা, ঋষি, পিতৃগণ, প্রাণীসকল, আত্মা ও আত্মীয়গণকে যথাযোগ্য অন্ন বিভাগ করে দেবে এবং সর্বভুতকে ঈশ্বররূপে দর্শন করবে । ধর্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তির ভোজন করাও কর্তব্য নয় ।
স্কন্দপুরাণে মার্কণ্ডেয়-ভগীরথ সংবাদে বর্ণিত আছে, বিদ্যাহীন বৈষ্ণবকে মূঢ়বোধে বেদবিদগণকে শ্রাদ্ধ প্রদান করলে বিপ্রকৃত সেই শ্রাদ্ধ রাক্ষস কর্তৃক গৃহীত হয় । বৈষ্ণব ব্যক্তি শ্রাদ্ধে গ্রাস-পরিমিত অন্ন ভোজন করলে এবং গণ্ডুষ-প্রমাণ জল পান করলেই সেই অন্ন সুমেরুসদৃশ হয় এবং সেই জল সমুদ্রতুল্য হয়ে থাকে ।
ব্রহ্মপুরাণে ব্রহ্মার উক্তিতে প্রকাশ আছে যে, শঙ্খচিহ্নে বিভুষিতাঙ্গ বিপ্র যে ব্যক্তির গৃহে ভোজন করেন, হরি স্বয়ং পিতৃগণ সহ সেই গৃহে তদন্ন সেবন করে থাকেন ।
স্মৃতিতে লিখেত আছে যে, শাতাতপ বলেছেন, অমৃত সুরাপাত্রস্থ হলে যেরূপ আশু ক্রিয়ার অনুপযুক্ত হয়ে উঠে, বৈষ্ণবহীন শ্রাদ্ধও সেইরূপ তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট (কর্মের অনুপযুক্ত) হয় ।
বিষ্ণুরহস্যে লিখেত আছে, প্রমাদবশে বৈষ্ণবজনকে অবৈষ্ণবগণের পংক্তিতে প্রবেশিত করলে সেই পংক্তিভেদী অধমকে দারুণ নিরয়ে নিমগ্ন হতে হয় ।
(পরবর্তী অংশ অপর পৃঃ-তে)
Comments
Post a Comment