শ্রাদ্ধ-বাসরে প্রধান আরাধ্য-দেবতার বর্ণনাসহ শ্রাদ্ধ-বাসরে ব্রহ্ম-ভুজ্যি/ভুরি ভোজনের ব্যাখ্যা, নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গে - ৩

(পূর্ববর্তী অংশের পর)

অতএব, উপরোক্ত শাস্ত্র-বাক্যসমূহ অনুসারে শ্রাদ্ধে তিনজন বেদবিৎ ব্রাহ্মণ অথবা বৈষ্ণব ভোজনের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত । তবে বিষ্ণুমন্ত্রোপাসকগণ অবশ্যই বৈষ্ণব-ভোজনের ব্যাপারেই গুরুত্ব দেবেন ।

তারপর আসছে নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গ ।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণে বলা আছে, -
“অশ্বমেধং গবালম্বং সন্ন্যাস পলপৈতৃকম্ ।
দেবরেণ সুতোৎপাদং কলৌ পঞ্চ বিবর্জ্জয়েৎ ।।”
অর্থাৎ অশ্বমেধ যজ্ঞ, গোমেধ যজ্ঞ, সন্ন্যাস, মৎস্যাদিদ্বারা পিতৃ-শ্রাদ্ধ ও দেবর দ্বারা পুত্রোৎপাদন - এই পাঁচটি কলিতে বর্জন করবে ।
শ্রীমদ্ভাগবতের সপ্তম স্কন্ধের পঞ্চদশ অধ্যায়ে নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলছেন, শ্রাদ্ধে আমিষ বা মৎস্য-মাংসাদি প্রদান করবে না ।
ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ বলছেন, যদি কোন ব্রাহ্মণ জেনেশুনে মৎস্য ভক্ষণ করেন, তবে তাহাকে ত্রিরাত্র উপবাসী থেকে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হতে হয় ।
ভগবন্নিষ্ঠ ব্যক্তি শ্রাদ্ধদিনে প্রথমতঃ ভগবানকে অন্ন প্রদান পূর্বক সেই নিবেদিত অন্ন দ্বারা শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করবেন । স্মৃতিতে উক্ত আছে যে, যাবৎকাল পিণ্ড প্রদান করা না হয়, তাবৎকাল পিত্রর্থে কৃতপাক অন্ন গৃহাগ্নি (শালাগ্নি), শিশু, দেবতা, যতি ও ব্রহ্মচারীগণকে অর্পণ করা নিষিদ্ধ । এই গৃহাগ্নি প্রভৃতি সামান্যবচন শ্রুতি-স্মৃতি-পুরাণ প্রভৃতির বিশেষবচন সকল দ্বারা নিঃসন্দেহ বাধা পেয়ে থাকে । 
পদ্মপুরাণে ঐ বিষয়ে লিখিত আছে যে, হরির নিবেদিত অন্ন দ্বারা অপরাপর সুরগণের পূজা করা বিধেয় ; আর পিতৃগণকে সেই হরিনিবেদিত অন্ন অর্পণ করবে । তাহলে উহা অক্ষয় ফলার্থ কল্পিত হয়ে থাকে ।
মোক্ষধর্মে নারদোক্তি আছে যে, সূর্যোক্ত বৈষ্ণববিধি আশ্রয় পূর্বক অগ্রে শ্রীভগবানের পূজা করে অবশিষ্ট অন্ন দ্বারা পিতামহগণের পূজা করবে ।
ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে লিখিত আছে, শ্রাদ্ধসময়ে ভক্তিসহকারে ভগবদুচ্ছিষ্ট মহাপ্রসাদ ও তদযোগে তুলসী-সমন্বিত পিণ্ড পিতৃগণকে বা সুরগণকে অর্পণ করলে তদীয় পিতৃগণ কোটিকল্প যাবৎ সম্যক্ তৃপ্তি লাভ করেন ।
স্কন্দপুরাণে শিবোক্তি আছে, সুরগণের উদ্দেশ্যে ও পিতৃগণের উদ্দেশ্যে হরিকে নিবেদিত দ্রব্য তত্তদ্দেবতা ও তত্তৎ পিতৃগণের উদ্দেশ্যেই অর্পণ করবে । যদি পিণ্ড অর্পণকালে বিষ্ণু-নিবেদিত সলিল মিশ্রিত করে দেওয়া যায়, তাহা হইলে উহা পিতৃগণের অতুল প্রীতি সাধন করে । হরি-অঙ্গলগ্ন চন্দন দ্বারা বিপ্রগণের বিলেপন-কার্য সম্পাদন করা কর্তব্য এবং পিতৃগণের তৃপ্ত্যর্থ উহারই দ্বারা পিণ্ড লেপন করবে । এইরূপ করলে নিঃসন্দেহ সুরগণের ও পিতৃগণের অক্ষয়া প্রীতি লাভ হয় ।
উক্ত পুরাণের পুরুষোত্তম খণ্ডে লিখিত আছে, পতিতজন কর্তৃক শ্রাদ্ধকালীন অন্ন দৃষ্ট হলে তৎশোধনার্থ তুলসী-সমন্বিত সলিল দ্বারা সেচন করবে এবং বিষ্ণুনৈবেদ্য সহ মিলিত হলেও উক্ত অন্ন বিশুদ্ধ হয় । সুতরাং বিষ্ণুর নৈবেদ্যাবশেষ ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করবে আর সম্যকপ্রকারে পিতৃগণের প্রীতিসাধনের বাসনা হলে পিণ্ডে হরির নৈবেদ্যাবশেষ অর্পণ করবে ।
উক্ত পুরাণের ব্রহ্ম-নারদ-সংবাদে লিখিত আছে, হে তাপসপ্রবর ! পিতৃগণকে উদ্দেশ্যপূর্বক জনার্দনের অর্চনা করলে মানবগণ নারকী যন্ত্রণা হতে পরিত্রাণ পেয়ে মোক্ষ লাভ করে । হে ঋষে ! সংসারে বিশেষতঃ কলিযুগে যে সমস্ত ব্যক্তি পিতৃগণের জন্য প্রত্যহ কেশবের অর্চনা করেন, তাঁরাই ধন্য । হে ঋষে ! যে সকল ব্যক্তি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন ভক্তিসহকারে জনার্দনের অর্চনা করেন, গয়াশ্রাদ্ধাদি বহু বহু পিণ্ড দান করে আর তাঁদেন কী প্রয়োজন ? হে ঋষিবর ! যাহার উদ্দেশ্যে জনার্দনের অর্চনা অনুষ্ঠিত হয়, তাহাকে নিরয়াবাস হতে পরিত্রাণ করে পরমপদে স্থাপন করা হয়ে থাকে । হে দেবর্ষে ! যে ব্যক্তি পিতৃগণের উদ্দেশ্য করতঃ জনার্দনকে স্থান প্রদান করেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে যত কিছু কর্তব্য অনুষ্ঠিত হতে পারে, তৎসমস্তিই তদ্বারা আচরিত হয়েছে ।
শ্রুতিতেও উক্ত আছে, কেবলমাত্র নারায়ণ বিদ্যমান ছিলেন, ব্রহ্মা ছিলেন না, দ্যাবা-পৃথিবীও তৎকালে ছিল না । সুরগণ, পিতৃগণ ও যাবতীয় মানব হরির ভুক্তান্ন আহার করেন, হরির আঘ্রাত দ্রব্য আঘ্রাণ করেন এবং হরির পীত বস্তু পান করেন, সুতরাং সুধীগণ হরি-নিবেদিত বস্তু সমস্ত আহার করবেন ।
এই হেতু ভগবান্ বিষ্ণুধর্মে বলে গেছেন, মদুদ্দেশ্যে নিবেদিত উত্তমান্ন প্রাণসমূহে আহুতিপ্রদান করবে, মদুদ্দেশ্যে নিবেদিত দ্রব্য ভোজনে নিরন্তর প্রাণাদি বায়ুসমূহ প্রীতি লাভ করে । অতএব যত্ন সহকারে প্রত্যেকের হৃদয়াধিষ্ঠিত পরমাত্মস্বরূপ আমাকে অধিকন্তু পিতৃবর্গকে মদুদ্দেশ্যে নিবেদিত অন্ন অর্পণ করবে ।
বিষ্ণুধর্মের স্থানান্তরেও লিখিত আছে, প্রথমতঃ অগ্রভুক্ ভগবানে কিছু ভক্ষ্য না দিয়ে পিতৃগণের উদ্দেশ্যে দিতে নেই ; কারণ, অনিবেদিত অন্ন অর্পণ করলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয় । সৃষ্টির প্রথমে হরিই অগ্রভুক বলে সুরগণ কর্তৃক কীর্তিত হয়ে থাকেন , তৎপরে তিনিই অমরবর্গকে যজ্ঞাংশভোক্তা রূপে নির্দেশ করেন ।
(পরবর্তী অংশ অপর পৃঃ-তে)

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

সর্ববর্ণে দশাশৌচ