বিবাহে যৌতুক প্রথার প্রবণতা এবং ব্যয় হ্রাস প্রসঙ্গে আলোচনা

জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য বিবাহ । ব্যষ্টি এবং সমষ্টি জীবনের শান্তি বিবাহের উপর নির্ভর করে । তাই বিবাহকে আমরা ‘শুভ’ বিশেষণে বিশেষিত করে বলি ‘শুভবিবাহ’ । স্বেচ্ছারিতা দ্বারা শুভকে পাওয়া যায় না । তার জন্য চাই সাধনা । হিন্দুর বিবাহে উচ্চ আদর্শ, গভীর তাৎপর্য এবং কল্যাণগর্ভ ভবিষ্যৎ বিধৃত । মনুপ্রমুখ-প্রচারিত হিন্দু বিবাহ চুক্তি নয় - ব্রত । চুক্তির পরিবর্তে মঙ্গলানুষ্ঠান বলেই স্নান, শুভ্র বসন পরিধান, উলুধ্বনি, সঙ্গীত, লাজবর্ষণাদির শুচি-সুন্দর আয়োজন । পাত্র নির্বাচনে অর্থের চেয়ে বিদ্যা ও সদাচারকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে শাস্ত্রে । বিত্ত এবং খ্যাতি নয় । গুণেরই সমাদর হিন্দু বিবাহে । অন্য সব কিছু থাকলেও গুণহীনকে কখনো কন্যাদান করা যাবে না । নির্গুণকে কন্যা দান না করে আইবুড়ো করে রাখাও ভাল বলে মনু মনে করেন ।
‘ন কন্যায়াঃ পিতা বিদ্বান্ গৃহ্নীয়াচ্ছুল্কমস্বপি ।
গৃহ্নন্ শুল্কং হি লোভেন স্যান্ নরোহপত্যবিক্রয়ী ।।
স্ত্রীধনানি তু যে মোহাদুপজীবন্তি বান্ধবাঃ ।।
নারী যানানি বস্ত্রং তে পাপা যান্ত্যধোগতিম্ ।।
(মনু সংহিতা - ৩/৫১-৫২)
বিবাহে অল্পমাত্র পণ গ্রহণ করাও হিন্দু শাস্ত্রমতে গর্হিত অপরাধ । যিনি পণ গ্রহণ করেন, তিনি অপত্যবিক্রয়ের অপরাধে অপরাধী । গোহত্যা ও অপত্যবিক্রয় শাস্ত্রমতে তুল্যদোষবিশিষ্ট উপপাতক । যারা পণ গ্রহণ করেন, তারা পতিত হয়ে যান । প্রায়শ্চিত্ত করে তাদের শুদ্ধ হতে হয় । পতিত ব্যক্তির ধর্মকর্মে অধিকার থাকে না । স্বেচ্ছায় বা আনন্দে যদি পণ দান করা হয়, সেই পণ এবং যৌতুকের সম্পদাদি স্ত্রী-ধনেই পরিণত হয় । বধুর স্ত্রী-ধনের ব্যবহার শ্বশুরালয়ে যে শ্বশুর, বর এবং পরিজনেরা করেন, সেই পুরুষেরা হিন্দুশাস্ত্র মতে অধোগতি প্রাপ্ত হয় । কনের বাড়ি থেকে লব্ধ পণের টাকায় বরের বাড়িতে আজকাল বৌভাত করার যে প্রবণতা তথাকথিত ধার্মিক এবং ধর্মবিরোধী গৃহাদিতেও দেখা যায়, তা একান্তই হিন্দুশাস্ত্রবিরোধী ।
                                                     ‘শুল্কেন যে প্রযচ্ছতি স্বসুতাং লোভমোহিতাঃ ।
আত্মবিক্রয়িণঃ পাপা মহাকিল্বিষহারিণঃ ।।
পতন্তি নরকে ঘোরে ঘ্নন্তিহাসপ্তমকুলম্ ।।’
শুল্কগ্রহণকারীকে আত্মবিক্রয়ী ও মহাঋণী বলা হয়েছে । যারা পণ গ্রহণ করে এবং দান করে উভয়েই তারা অধস্তন সপ্তম পুরুষ পর্যন্ত নরকে পতিত হয় ।
শাস্ত্রমূর্ত্তি শ্রীমৎ সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব পণ গ্রহণের বিরুদ্ধে সমাজকে সচেতন করে বলেছেন, -
‘ওরে তোরা ছেলে বেচিস্ না ।’
সুতরাং এইমূহুর্ত থেকে আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত যে আমরা বিয়েতে কোনরূপ পণ দেব অথবা নেব না ।
আজকাল দেখা যায় বিবাহোপলক্ষে যে গেইট এবং কুঞ্জ তৈরী করা হয়, তার সাথে শাস্ত্রের কোন সঙ্গতি নেই । হিন্দু বিবাহ একটি যজ্ঞ বিশেষ । সুতরাং যজ্ঞস্থলে প্রবেশের তোরণ হওয়া উচিত পতাকা-পুষ্পমালায় শোভিত কলাগাছ রোপণ করে । কুঞ্জও তদ্রূপ হওয়া উচিত । উপরন্তু হিন্দু বিবাহে বরকে গণ্য করা হয় বিষ্ণুপুরুষরূপে এবং কনেকে গণ্য করা হয় লক্ষ্মীরূপে । তদুপরি বিবাহের পূর্বদিনে মায়েরা সম্মিলিতভাবে দেব-বাড়িসমূহে গিয়ে পান-চিনির তত্ত্বের মাধ্যমে দেবতাদের আমন্ত্রণ করে আসেন । সুতরাং এসকল দিক ভালভাবে বিচার করে  বিয়ে বাড়িতে অন্য কিছু সম্ভব না হলেও প্রাণী-মাংস অবশ্যই পরিহার করা উচিত । এতে করে আমরা যেমন অনুষ্ঠানের পবিত্রতা রক্ষা করতে পারি, তেমনি অযথা ব্যয়-বাহুল্য থেকেও রক্ষা পেতে পারি । এ ব্যাপারেও আমাদের এক্ষণি সিদ্ধান্তে আসা উচত বলে আমি মনে করি ।
তদুপরি যারা কম্যুনিটে সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করে থাকেন, তাদের ভাবা উচিত ঐ সেন্টারে দুপুরে মুসলমান-বিয়েতে যে হাঁড়িতে গো-মাংস রন্ধন করা হয়েছে, ঠিক একই হাঁড়িতে রাত্রিতে অন্য মাংস রন্ধন করা হচ্ছে । সুতরাং স্পর্শদোষে বামুন থেকে সবাই গো-মাংসই ভোজন করছে । আর যে বামুন ওখানে প্রকাশ্যে মাংস চিবোচ্ছে, সে-ই পরবর্তী সময়ে সমাজে এসে জাতের বাহাদুরি দেখাচ্ছে । এসব ভণ্ডামিও সমাজদেহ থেকে দুর করতে হবে ।

Comments

Popular posts from this blog

সর্ববর্ণে দশাশৌচ

শ্রাদ্ধ-বাসরে প্রধান আরাধ্য-দেবতার বর্ণনাসহ শ্রাদ্ধ-বাসরে ব্রহ্ম-ভুজ্যি/ভুরি ভোজনের ব্যাখ্যা, নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গে - ৩