বিবাহ
নানক কান্তি সেন

সনাতন ধর্মে দশবিধ সংস্কারের মধ্যে বিবাহ অন্যতম । মূলতঃ এটিই প্রথম সংস্কার । এর উপরই নির্ভর করে অন্যান্য সংস্কারগুলো । সুতরাং এটি যদি শাস্ত্রনির্দেশিত পথে নির্বাহ না হয়, তাহলে গোটা জীবনটাই আলোথালো হয়ে সমাজের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।
(১) বিবাহে বর ও কনেকে তুলসীর মালা পরিধান করতে হয় । অনেকে না জেনে বেলের মালা ব্যবহার করেন, এটা সম্পূর্ণ ভুল । তুলসীর মালা কেন পরিধান করতে হয় তা অনেকেই জানেন না । প্রথমতঃ প্রাচীন কালে শাস্ত্রাদি অধ্যয়ণ শেষে গুরুকুল থেকে গুরুর অনুমতি নিয়ে গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রবেশ করতে হতো । দ্বিতীয়তঃ ব্রহ্মচর্য্য আশ্রম থেকেই দীক্ষিত হতে হয় । তুলসীর মালা পরিধান তারই চিহ্ন । যার জীবনে ব্রহ্মচর্য্য শিক্ষা হয় নাই, সে কক্ষণো আদর্শ গৃহস্থ হতে পারে না । তৃতীয়তঃ বিবাহে বরকে বিষ্ণুপুরুষ হিসেবে গণ্য করা হয় । সুতরাং বিষ্ণুপরুষের গলায় মালা থাকবে না, এটা হয় না । মালাবিহীন বিবাহ সম্পূর্ণ অশাস্ত্রীয় । 
(২) আমরা অভিভাবকেরা কিন্তু সূচনা লগ্নেই গুরুতর অপরাধ করে আসছি । মেয়ে নির্বাচন করতে গিয়ে তার গুণের বিচার না করে তার বংশ ও রূপ বিচারেই মগ্ন হই । অথচ মনু বলছেন, অতি নীচ কুলেও যদি গুণসম্পন্না কন্যারত্ন মিলে, তাকেই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা যায় । “স্ত্রীরত্ন দুষ্কুলাদপি” । দ্বিতীয়ত বিশেষ করে বর্ণাভিমানীরা বংশ আর কুল দেখতে গিয়ে অযথা কলক্ষেপ করেন আর তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মেয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ছেলের ঘরে চলে গেছে । এক্ষেত্রে আবার দেখা যায় যদি মেয়ে স্বধর্মেরই কোন নীচ কুলজাত ছেলের সাথে যায়, সেক্ষেত্রে মেয়ের বাপের হম্বিতম্বি গগনচুম্বি হয়ে উঠে কিন্তু মেয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর ঘরে চলে গেলে হাসিমুখে তারিই সাথে পীরিতিতে মগ্ন হয় । এটা অত্যন্ত সামাজিক সর্বনাশের কারণ ।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জানা উচিত সনাতন ধর্মজগতের মূল ধর্মগ্রন্থগুলির রচয়িতা ব্যাসদেব অসবর্ণ প্রণয়েরই ফসল । গোড়া থেকেই এ ধর্ম স্বীকার করে আসছে, ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক বড় ।’ আজ যারা অসবর্ণ বিয়ে নিয়ে সমাজে বসে ফালতু গণ্ডগোল পাকানোর  চেষ্টা করছেন, তারা প্রকারান্তরে শাস্ত্রকেই অস্বীকার করছেন । তাছাড়া বামুনর ঘরের মেয়ে বামুন হতে যাবে কেন ? তার তো প্রাচীনকালের মতো উপনয়নও নেই, নেই বেদপাঠে অধিকার । সুতরাং শাস্ত্রগতভাবে সেও শূদ্রই । আর শূদ্র বলেই বামুন যখন আহারে বসেন, স্ত্রীকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় পাছে তার স্পর্শে কর্তার আহারে বিঘ্ন হয় ।
তৃতীয়তঃ অভিভাবকেরা ছেলেকে বিয়ে করাতে  গিয়ে মেয়ের বাড়িতে পণ আদায়ের নামে ছেলেকে মেয়ের কাছে বিক্রয় করে আসে । মনুসংহিতায় বলা আছে, ‘বিবাহে পণ গ্রহণ কিংবা প্রদান দুটোই শাস্ত্রমতে অপত্যবিক্রয়তুল্য অপরাধ । যারা এ ধরণের অপরাধী, তারা সকল ধর্মকর্ম থেকেই ভ্রষ্ট হয় । তাদেরকে প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হতে হয় ।’ 
পাত্রী নির্বাচনে দেখা যায় অনেককেই চাকুরীরত মেয়ে খুঁজছেন । অর্থাৎ ছেলে স্ত্রীর উপার্জনের উপর নির্ভরশীল । এরা তখন না পায় বৌ, না পায় মেয়ে । ঠাকুর অনুকুল চন্দ্র বলেছেন, “যে মেয়েরা চাকরী করে, জনন-জাতি তারাই হরে ।।” “মেয়ের চাকরী মহাপাপ । বিপর্যস্ত শ্বশুর বাপ ।।” এদের সন্তানগুলোও পাখীর বাচ্চার মতই বড় হয় । এরা বড় হলে আর মা-বাবার দিকে ফিরেও তাকায় না ।
 দেখবেন, বিয়ের পূর্বদিনে বিশেষ করে মায়েরা আশেপাশের দেবালয়গুলো ও ঘরে ঘরে গিয়ে পানচিনির তত্ত্ব দিয়ে দেবতাসহ সবাইকে নিমন্ত্রণ করে আসেন । কিন্তু তার পরের দৃশ্যপট একেবারেই ভিন্ন । বাড়িতে তখন বসে প্রাণীহত্যার আসর । নিমন্ত্রিত দেবতারা বাড়ির প্রবেশমুখ থেকেই বিমুখ হয়ে বিনা আশীর্বাদ প্রদানেই ফিরে যান । অথচ শাস্ত্রে আছে, তুমি যে প্রাণীকে হত্যা করলে তার মাংস আহারের জন্য, ঐ প্রাণীর শরীরে যত রোম আছে, তোমাতে তত হাজার বছর নরকে পচতে হবে । মহাভারতে ভীষ্ম বলছেন, অন্য প্রাণীর মাংসকে নিজের পুত্রের মাংস বলে জানবে । এটা জেনেও যে মাংস ভক্ষণ করে, সে অবশ্যই আত্মঘাতী ।
প্রতিটি মা-বাবার উচিত শিশুকাল থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে সাথে নিজের সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া । যে পিতা-মাতা তা না করেন, তারা নিজেরাই যমতুল্য বলে শাস্ত্র নির্দেশ করেছেন ।

Comments

Popular posts from this blog

সর্ববর্ণে দশাশৌচ

শ্রাদ্ধ-বাসরে প্রধান আরাধ্য-দেবতার বর্ণনাসহ শ্রাদ্ধ-বাসরে ব্রহ্ম-ভুজ্যি/ভুরি ভোজনের ব্যাখ্যা, নিরামিষ বা আমিষ আহার প্রসঙ্গে - ৩