ব্রাহ্মণ প্রসঙ্গ
শ্রীমদ্ভাগবতে ব্রাহ্মণ প্রসঙ্গ
নানক কান্তি সেন
বহু
গ্রন্থ প্রণেতা, বৈষ্ণবোত্তম, গুরু-নিবেদিত প্রাণা মনোজদা (মনোজবিকাশ দেবরায়)
প্রচুর শ্রম দিয়ে উপরোক্ত গ্রন্থ প্রণয়ণ করেছেন। প্রশ্ন হলো, এরূপ গ্রন্থ প্রকাশে
কারা বেশী লাভবান হচ্ছেন। এতে লাভবান হবার আশা পোষণ করছেন সে সমস্ত ব্রাহ্মণ যারা
কুল আর পৈতার ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আর সবাইকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ ভাবছেন।
মনোজদা
একবারও ভেবে দেখলেন না ভাগবতের সময়কার ব্রাহ্মণ আর কলির অভিশপ্ত ব্রাহ্মণের মধ্যে
যোজনব্যাপী ফারাকের কথা। ভাগবতের ব্রাহ্মণ সমাজের সাথে কোনরূপ প্রতারণা করেননি যা আজ
কলির নামধারী ব্রাহ্মণেরা করে যাচ্ছেন। ভাগবতের ব্রাহ্মণ কক্ষণো মিথ্যার আশ্রয়
নেননি আর আজকের পৈতাসম্পন্ন অধিকাংশ ব্রাহ্মণই যে মিথ্যা কথা দিনের মধ্যে কতবার
কতভাবে বলছেন, তার ইয়ত্তা নেই।
এবার
মনোজদার কাছে প্রশ্ন, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যও ব্রাহ্মণ, দেবগুরু বৃহস্পতিও
ব্রাহ্মণ। তিনি কোন্ ব্রাহ্মণের শরণ নিলেন। যদি উভয় দিকেই তিনি ঝুঁকে থাকেন, তাহলে
কী সাধনার নিষ্ঠা থাকে ?
মনোজদা
ঐ গ্রন্থ প্রণয়নের পূর্বে মনে হয় ভুলে গেছেন যে যে গ্রন্থ থেকে তিনি ঐ সকল কথা চয়ন
করেছেন, সেই গ্রন্থটিও এমন একজন লিখেছেন, যাঁর জন্মটাই কুমারী কৈবর্ত কন্যার গর্ভে
। তিনি যাঁর উপদেশামৃত লাভ করে গ্রন্থ সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সেই উপদেষ্টারও জন্ম
দাসীগর্ভে ।
তারপর
নৈমিষারণ্যে যিনি শৌনক মুনি আহুত সভায় ভাগবত প্রবচন দিচ্ছিলেন, তিনিও কিন্তু
জন্মগতভাবে ব্রাহ্মণ ছিলেন না।
মনোজদা
যে ভাব নিয়ে এই গ্রন্থটি লিখেছেন, তাতে কী তিনি গীতা বা মহাভারত থেকে সরে যান নি,
ভেবে দেখার মতো।
আর
তাছাড়া এমন এক সময়ে তিনি এ গ্রন্থ লিখেছেন যখন চারিদিকে অশাস্ত্রজ্ঞ সমাজের রক্ত
শোষক শকুনিবৃত্তিধারী ব্রাহ্মণরা তৎপর হয়ে উঠেছে তাদের আহার সংগ্রহে। এতে করে তিনি
সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সাথে বৈমাত্রেয় আচরণটাই করলেন।
তাঁর
এই গ্রন্থের আশীর্বাণীতে প্রফেসর নিখিল ভট্টাচার্য মহোদয় লিখেছেন, “কলিযুগে
ব্রাহ্মণ বহুলাংশে মহিমাচ্যুত। অন্যেরা এই চ্যুতিই অন্বেষণ করে, মহিমা অন্বেষণ
করতে চায় না।“ নিখিলদা আমারও গুরুজন। তাঁর সাথে আমার আত্মার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ।
তাঁর স্থান আমার কাছে আজীবন থাকবে উচ্চাসনে। তবে তাঁর কথা দিয়েই উত্তর দিচ্ছি।
তিনি যে গ্রামে জন্ম নিয়েছেন, আমা থেকে তিনি ভাল করেই জানেন যে ঐ গ্রামের অন্যান্য
ব্রাহ্মণ নামধারীরা কেমন জীবন যাপন করছেন । একথা ভেঙে বলতে গেলে নিজের মুখটাও
দূষিত হয়। এদের অনেকেরই মুসলমান জামাতা। এদের খাদ্যাখাদ্য দেখলে শূদ্রও লজ্জা
অনুভব করে। এদের অনেকের কাছেই নিখিলদাও চক্ষুশূল। বককুলের মধ্যে হংসের মতোই ঐ
গ্রামে নিখিলদার আগমন। এখন বলুন তো আমরা কী বকের পূজো দিব না হংসের ? অপাত্রে পূজা
দান তো গীতা, মহাভারত বা অন্যান্য উপনিষদের অভিপ্রেত নয় । মনোজদার এই গ্রন্থে ঐ
মহিমাচ্যুত ব্রাহ্মণেরাই পুষ্টিলাভ করবে, সন্দেহ নেই।
প্রফেসর
নন্দলাল শর্মা তাঁর আশীর্বাণীতে লিখেছেন, ‘আশা করি গ্রন্থটি আমাদের জ্ঞানচর্চা ও
ভক্তিচর্চার ক্ষেত্রে যে নতুন গবাক্ষ উন্মোচন করল তা আরো সম্প্রসারিত হবে।’
জ্ঞানচর্চা ও ভক্তিচর্চা কতটুকু হবে, তা আগামী দিনের ভবিষ্যতই বলবে তবে এই গ্রন্থ
যে পরচর্চা ও বিদ্বেষচর্চাতে অগ্রণী ভুমিকা রাখবে, এতে কোনই সন্দেহ নেই। এতে করে আচারভ্রষ্ট ব্রাহ্মণেরাও শতগুণ উৎসাহিত
হয়ে তাদের কপট বৃত্তি ও অন্য বর্ণের প্রতি উৎপীড়ণে মনোযোগী হবে।
শ্রীনিরঞ্জন
গোস্বামী ‘ব্রাহ্মাননং’-এ লিখেছেন, ‘ব্রাহ্মণ তাঁর মুখ, ক্ষত্রিয় তাঁর বাহু, বৈশ্য
তাঁর উরু এবং শূদ্র সেই বিরাট পুরুষের চরণ।’ গোস্বামীজী কী লক্ষ্য করেছেন যে চরণের
উপর নির্ভর করেই শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে । তা মুখটাই বড় আর চরণটাই যখন হীন, তাহলে আপনাদের
চরণদুটি এই মূহুর্তে কেটে ফেলা হোক, কী বলেন ? দেখি তো চলাফেরা করতে পারেন কি না।
আরও মজার কথা হলো, বিরাট পুরুষের যে চরণ থেকে শূদ্রের উৎপত্তি, সেই চরণ থেকেই
কিন্তু পতিতপাবনী গঙ্গার উৎপত্তি আর সেই গঙ্গায় আপনারাও তো মুখশুদ্ধ সকল অঙ্গ
ডুবিয়েই স্নান করেন, তাই না ?
মনোজদা
যাদের কল্যাণের জন্য এই পরিশ্রম স্বীকার করলেন, তারা তার মূল্য দিতে পারবে তো ?
তারা পারবে তো যথার্থ ব্রাহ্মণ বলে নিজেদের পরিচয় দিতে ?
মনোজদা
নিজেই নিজের নিবেদনে ধরা পড়ে গেলেন অথচ বুঝতে পারলেন না, এটাই আশ্চর্য । তিনি
লিখেছেন, ‘মদীয় গুরুপাদপদ্ম ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী তাঁর জীবদ্দশায় ব্রাহ্মণদেরে
অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তিনি ১৯৮৩ সালে গৌরতীর্থ পরিক্রমায় শচীমায়ের
জন্মভুমি জয়পুর গ্রামে আসেন। সেই পরিক্রমাতে গুরুদেবের সঙ্গী ছিলেন বাণীবংশকুলতিলক
নিকুঞ্জ বিহারী গোস্বামী। জয়পুরে শচীঅঙ্গনে মন্দির নির্মাণের মূল দায়িত্ব তিনি
সমর্পন করেছিলেন প্রফেসর নিখিল ভট্টাচার্যকে। প্রফেসর ভট্টাচার্যের চেষ্টায়
শচীঅঙ্গনে মন্দিরটি প্রথম নির্মিত হয়। সে সময়ে শ্রীগুরুদেব কোথায় প্রসাদ গ্রহণ
করবেন এ বিষয়ে এক গুঞ্জন হতে থাকে। এ সকল কথা শুনে প্রফেসর ভট্টাচার্য
শ্রীগুরুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন, মহারাজজি ! আপনার প্রসাদ গ্রহণের জন্য কেউ কেউ
বলছেন বৈষ্ণব এনে রান্নার ব্যবস্থা করার জন্য। গুরুজী মৃদু হেসে বললেন, কে এমন কথা
বলেন ? আপনি ব্রাহ্মণ সন্তান। আপনি ভালভাবে জানেন একজন ব্রহ্মচারী কোথায় প্রসাদ
নিতে পারেন ? আমি আপনার উপর ভরসা করি। আপনি বলুন আপনি কী ব্যবস্থা করেছেন ?
প্রফেসর ভট্টাচার্য বললেন, এ গ্রামেই আমার ছাত্র উমাপদ ভট্টাচার্যের বিধবা মাতা
আছেন। তিনি নিরামিষভোজী। প্রতিদিন দুপুরে এ বাড়িতে শালগ্রাম শিলা পূজিত হন এবং
অন্নভোগ নিবেদিত হয়। তিনি ভোগ রান্না করবেন এবং ভোগ নিবেদনের পর এই প্রসাদ আপনি
নিবেন। প্রফেসর ভট্টাচার্যের এই প্রস্তাব আজন্ম ব্রহ্মচারী বৈষ্ণবাচার্য ড. মহানামব্রত
ব্রহ্মচারী সানন্দে অনুমোদন করলেন এবং এই ব্রাহ্মণবাড়িতেই প্রসাদ নিলেন।
এবারে
ভাবার অনুরোধ করছি মনোজদাকে । ঐ গ্রামে তো আরও অনেক ব্রাহ্মণ ছিলেন । তাদের কাউকে
না বেছে উমাপদ ভট্টাচার্যের বিধবা মাতাকেই বরণ করে নেওয়া হলো কেন ? কারণ তিনি
নিরামিষভোজী আর প্রতিদিন দুপুরে শালগ্রাম শিলা পূজা শেষে তাঁর বাড়িতে অন্নভোগ
দেওয়া হয়। এবার বুঝলেন তো মনোজদা আমিষভোজী আর প্রসাদভোজী ব্রাহ্মণের তফাৎটা কোথায় ?
এখানেও তো বিচার করতে হলো। এমনিভাবেই বিচার করে চলতে হবে গুণ ও কর্মের দ্বারা কারা
ব্রাহ্মণ আর কারা পথভ্রষ্ট।
পরিশ্রম
করেছেন অনেক তবে এই পরিশ্রমটা যদি শোষিত সমাজের কল্যাণে আসতো, তাহলে আপনি পেতেন
আরও বেশী পুরস্কার। মনোজদা, নীচে যারা পড়ে আছে, তাদের জন্য আপনার ইষ্টদেবতা ও
গুরুদেবও অনলস পরিশ্রম করে গেছেন। আপনিও মনে প্রাণে কায়মনোবাক্যে তাদের পাশে
দাঁড়াবেন, তাহলেই আপনার সকল ক্রিয়াকাণ্ড হবে সার্থক। গুটিকয়েক ব্রাহ্মণের প্রশংসায়
আপনার জীবনে সার্থকতা এনে দেবে না, এই উপলব্ধি আপনার হোক, প্রভুর চরণে এটাই
প্রার্থনা। মনে রাখবেন, আপনার প্রভু সমাজের বাঁধ ভেঙে দিয়েছেন। জনারণ্যে মিশে
গেছেন। অবলীলায় হরিনামে শোধিত বুনোর হাতেও খেয়েছেন কিন্তু হরিভক্তিবিহীন
ব্রাহ্মণের মুখও দর্শন করেননি।
Comments
Post a Comment