গীতার প্রথম ষটক
নানক কান্তি সেন
গীতার প্রথম ষটককে আচার্যপাদেরা কর্মের ষটক নামে অভিহিত করেছেন । ষটকটি শুরু হয়েছে অর্জুনবিষাদযোগ দিয়ে । শত্রæতাপন বীর অর্জুন বিষাদগ্রস্ত । যুদ্ধক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়-¯^জন ও গুরুজনদেরকে বিপক্ষে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন । ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ন্যায়যুদ্ধ করাটাও কর্তব্যকর্ম । অর্জুন সেই ভুমিকা থেকে ভ্রষ্ট । আমরাও হই । সংসারে নানাভাবে আমরা বিষাদগ্রস্ত হই । কিন্তু আমাদের বিষাদ যোগে পরিণত হয় না । অর্জুনের হয়েছে । কারণ অর্জুন তাঁরই সামনে বিষাদগ্রস্ত হয়ে চোখের জল ফেলছেন যিনি এ জগতের সবার বিষাদ দুর করতে সমর্থ । তাই তার বিষাদ যোগে পরিণত হয়ে গেছে । আর আমরা ? আমরা কি কখনও তাঁর সামনে কেঁদেছি, ব্যক্ত করেছি আমাদের বিষণœতা ? উল্টো আমরাই যাই অন্যের চোখের জল মোছাতে । কী যোগ্যতা অঅছে আমাদের অন্যের বিষাদ দুর করণের ? নিজেরাই যেখানে প্রতি পলে পলে বিষণœতায় কাঁদছি, সেখানে কোন্ যোগ্যতা রাখি অন্যের বিষণনতার অশ্রæ মুছিয়ে দিতে ? অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হয়ে তার কর্তব্যকর্ম থেকে সরে গেছেন । যে কলুষতা, হৃদয়ের যে ক্ষুদ্র দুর্বলতা, যে অনার্যসুলভতা অর্জুনের বীরত্বকে ক্লীবত্বে পরিণত করে দিয়েছে, সেখান থেকে তাকে তুলে এনে কর্তব্যকর্মে প্রচোদিত করছেন ¯^য়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ । গুরুজনও যদি আততায়ীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হন, তিনি যদি পর¯^াপহরণ করেন, তিনি যদি ব্যভিচারী হন, তিনি যদি পরনারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের সহযোগী হন, তিনি যদি পরগৃহে অগ্নিসংযোগের সহচর হন, তবে তিনি বিনা বিচারে বধ্য, শাস্ত্রের এই মহাবাক্য ভুলে গিয়ে এককালের বিশ্ববিজয়ী হিন্দু আজ ক্লীবত্বের দাসত্ব করছে । আজ তারই চোখের সামনে তার নিজের মা-বোন হচ্ছে অন্যের হাতে ধর্ষিত, তার সহায়-সম্পদ জোর করে দখলে নিচ্ছে অন্যেরা আর হিন্দু ক্লীবের মতো বসে বসে চোখের জল ফেলছে । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -
“ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি
তথা, তোমার আদেশে ।”
এককালের করিৎকর্মা হিন্দু আজ সেজেছে নিষ্কর্মার ঢেকি । সঠিক কর্তব্যকর্ম থেকে দুরে সরে গিয়ে সস্তাপথে খুঁজছি ¯^র্গে যাবার ঠিকানা কিন্তু এতটাই আহাম্মক আমরা যে একবারও ভেবে দেখছি না ঐ পথে ¯^র্গ পাবার আশা দুরাশাই মাত্র । যে মহাভারতের অন্তর্গত গীতা, সেই মহাভারতেরই একটি পর্বের নাম মহাপ্রস্থানিক পর্ব যেখানে দেখানো হয়েছে কি ভাবে পঞ্চপাণ্ডব ¯^র্গের পথে চলছিলেন কিন্তু দেখা যায় সবাই পথে পড়ে গেলেন, কেবলমাত্র যুধিষ্ঠিরই সশরীরে ¯^র্গে প্রবেশ করলেন । কেন করতে পারলেন যুধিষ্ঠির, একবারও কী সেটা ভেবে দেখেছি আমরা ? আর সেই আমরাই শ্রাদ্ধ বাসরে গীতা পাঠ করে বোকার মত তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, সস্তা দামের গীতা বাজার থেকে কিনে এনে জীবনে কোনদিনই গীতা ছুঁয়েও দেখেনি এমন বামুনদের গীতা দান করে গীতার অবমাননার মধ্য দিয়ে ভাবছি পিটতৃপুরুষ কী নির্বিবাদে ¯^র্গে পৌঁছে গেল । যদি হিন্দু আজও মনোযোগ দিয়ে গীতার বাণী শুনে, গীতার মূল প্রতিপাদ্য অনুধাবণ করতে পারে, তবেই প্রতিটি হিন্দু অর্জুনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার হৃতগৌরব পুনরায় অর্জনে সক্ষম হতে পারে ।
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাংখ্যযোগ । এই অধ্যায়েই ভগবান কথা বলা শুরু করেছেন । প্রথম কথাটাই ছিল অর্জুনের প্রতি -
অশৌচ্যের তরে কাঁদ, মুখে বিজ্ঞ বাণী ।
জীবিত ও মৃতে ভেদ, না করেন জ্ঞানী ।।
আমরাও একই ধরণের বিজ্ঞতা দেখাই যত্র তত্র । অন্তরে নেই বিন্দুমাত্র শাস্ত্রের অনুভুতি । একই কথা বলতে শুনি মহাপ্রভুর মুখে -
যেবা মিশ্র চক্রবর্তী ভট্টাচার্য সব ।
তাহানাও নাহি জানে গ্রন্থ অনুভব ।। গ্রন্থের কথা, শাস্ত্রের কথা যথার্থভাবে উপলব্ধি হয় না অনেকেরই । কারণ সৎগুরুর কৃপা, মহৎ জনের কৃপা তদুপরি শাস্ত্রের কৃপা ভিন্ন ভিতরের কথা কারো পক্ষেই উদঘাটন করা সম্ভব নয় । অর্জুন যাঁর কাছ থেকে শুনছেন, তিনি হচ্ছেন জগ˜গুরু ‘কৃষ্ণং বন্দে জগ˜গুরুম্ ।’ অসীম জ্ঞানের উৎস তিনি ।
গীতার ২য় অধ্যায়ের ৪৮নং শ্লোকে বলছেন -
মনে প্রাণে ভগবানে করিয়া আশ্রয় ।
‘যোগস্থ’ হইয়া কর্ম কর ধনঞ্জয় ।।
সিদ্ধি কিংবা অসিদ্ধিতে অচঞ্চল চিত ।
সেই ‘সমজ্ঞান’ যোগ নামেতে কথিত ।।
সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কর্মটাও যোগে পরিণত হয়ে যায় যদি কেউ সর্বকর্মেই তাঁর সাথে নিজেকে যোগ করে দিতে পারে । কোন কর্মে বা কর্মের ফলে, কোন দেশ, কাল, ঘটনা পরিস্থিতি, অন্তঃকরণ,বহিঃকরণ ইত্যাদি প্রাকৃত বস্তুতে আসক্তিরহিত হয়েনির্লিপ্তভাবে কর্ম করে যেতে হবে । সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমজ্ঞান রাখতে হবে । কর্ম সম্পূর্ণ হওয়া বা না হওয়া, জাগতিক দৃষ্টিতে তার ফল অনুকুল হওয়া বা প্রতিকুল হওয়া, ঐ কর্ম করায় প্রশংসা বা নিন্দা হওয়া বা না হওয়া ইত্যাদি যে সমস্ত সিদ্ধি বা অসিদ্ধি আছে, তাতে সম থাকা উচিত, সমান জ্ঞান করা উচিত । কর্মযোগীর সমভাব এমন হওয়া উচিত যাতে কর্ম সম্পন্ন হোক বা না হোক, ফলপ্রাপ্তি হোক বা না হোক, নিজের মুক্তি হোক বা না হোক - আমার কেবল কর্তব্য পালন করে যাওয়াই উচিত ।
তৃতীয় অধ্যায়ের নাম কর্মযোগ । এই অধ্যায়ের ৩০নং শ্লোকে ভগবান বলছেন -
“ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সন্ন্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীনির্মমো ভুত্বা যুধ্য¯^ বিগতজ্বরঃ ।।
সর্বকর্ম আমাতেই করি সর্বক্ষণ ।
আমার আজ্ঞায় কর্ম কর সমর্পণ ।।
এই জ্ঞানে মায়া-মোহ ত্যজি শোক ভয় ।
অনাসক্ত চিত্তে যুদ্ধ কর ধনঞ্জয় ।।
প্রকৃতপক্ষে জগতের সমস্ত ক্রিয়াই কেবলমাত্র ভগবানের শক্তিতেই হয়ে থাকে । শরীর ইন্দ্রিয়াদি, পদার্থ ইত্যাদিও ভগবানের এবং শক্তিও তাঁরই । এজন্য সবকিছুই ভগবানের এবং ভগবান্ আমার - গভীরভাবে এই বিচার করে যখন তুমি কর্তব্যকর্ম করবে, তখন ঐ কর্মগুলি আর তোমার বন্ধনকারক হবে না বরং মুক্তিদায়ক হয়ে উঠবে । সেইজন্য যে সমস্ত কর্তব্যকর্ম এসে উপস্থিত হয়, সেগুলি নিষ্কাম, মমত্বহীন এবং নিঃসন্তাপ হয়ে ভগবদর্পণ বুদ্ধিতে করা উচিত ।
ষটকটির ৪র্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগ । ঐ অধ্যায়ের ৪১নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“যোগসন্ন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংচ্ছিন্নসংশয়ম্ ।
আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধœন্তি ধনঞ্জয় ।।”
ঈশ্বরে অর্পিত কর্ম, জ্ঞানে অসংশয় ।
আত্মজ্ঞানী কর্মে বদ্ধ নহে ধনঞ্জয় ।।
জগতে দিনরাত নানাপ্রকার কর্ম সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু সেসব কর্মে আমাদের আসক্তি বা অনুরাগ না থাকায় আমরা সে সকল কর্ম দ্বারা আবদ্ধ হই না, নির্লিপ্ত থাকি । যে সব কর্মে আমাদের অনুরাগ বা আসক্তি আসে, সেই কর্ম দ্বারা আমরা আবদ্ধ হই, কারণ রাগ-দ্বেষের দ্বারাই কর্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয় । যখন রাগ-দ্বেষ থাকে না অর্থাৎ সমত্ববোধ জাগ্রত হয়, তখন কর্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না ; অতএব মানুষ কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যায় ।
ষটকটির ৫ম অধ্যায় হলো কর্মসন্ন্যাসযোগ । এই অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত¦া করোতি যঃ ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ।।”
ব্রহ্মে সমর্পিয়া, ফল তেয়াগিয়া, কর্ম করে যেই জন ।
সে নহে কখন, পাপে নিমগণ, পদ্মে সলিল যেমন ।।
শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, প্রাণ ইত্যাদি সবকিছু ভগবানেরই, নিজের নয় । সুতরাং এদের দ্বারা হওয়া ক্রিয়াগুলিকে ভক্তিযোগী কী করে নিজের বলে মনে করবেন ? সেজন্য তাঁর এই ভাব থাকে, ‘ক্রিয়ামাত্রই ভগবানের দ্বারা এবং ভগবানের জন্যই হচ্ছে, আমি তো নিমিত্তমাত্র ।’
ভগবানই আমার ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নিজেই সব ক্রিয়া করছেন - এ কথাটি ঠিকভাবে উপলব্ধি করে সমস্ত ক্রিয়াগুলির কর্তা ভগবান এরূপ ¯^ীকার করা হল ‘ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি’ ।
এটি অত্যন্ত লক্ষণীয় বিষয় যে, ভগবানের শরণাগত হয়ে ভক্তিযোগী সংসারে থেকে ভগবানে নিবেদিতভাবে কর্মসম্পন্ন করলে কর্ম দ্বারা বন্ধনপ্রাপ্ত হন না । যেমন পদ্মপাতা জলে উৎপন্ন হয়ে, জলে থেকেও জল থেকে নির্লিপ্ত থাকে, তেমনি ভক্তিযোগী সংসারে থেকে সমস্ত ক্রিয়া করলেও ভগবানের শরণাগত হওয়ায় সংসারে সর্বদা সর্বতোভাবে নির্লিপ্ত থাকেন । একই কথা বলেছিলেন মহাপ্রভু সপ্তগ্রামের জমিদার হিরণ্য-গোবর্ধনের পুত্র রঘুনাথকে । রঘুনাথ যখন সংসার থেকে পালিয়ে মহাপ্রভুর কাছে গেলেন বৈরাগ্যমন্ত্রে দীক্ষিত হতে, তখন মহাপ্রভু তাঁকে বলেছিলেন, ‘গৃহে ফিরে যাও রঘুনাথ -
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া ।
যথাশক্তি বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্তি হঞা ।।
অন্তরে নিষ্ঠা কর, বাহ্যে লোক-ব্যবহার ।
অচিরাতে কৃষ্ণ তোমা করিবে উদ্ধার ।।
ভগবানের প্রতি বিমুখ হয়ে সংসারের কামনা করাই সমস্ত পাপের প্রধান কারণ । কামনা উৎপন্ন হয় আসক্তি থেকে । আসক্তি সর্বতোভাবে দুর হলে কামনা থাকে না । তাই পাপ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না ।
কর্মষটকের শেষ অধ্যায় হলো অভ্যাসযোগ । এই অধ্যায়ের ৩নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে ।
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ।।”
কর্মই জ্ঞান, কর্মই সাধনা যে জানে ।
সমাধি লভে সেজন কর্ম-অবসানে ।।
ফল প্রাপ্তিতে আমাদের সমতা আছে কি নেই, আমাদের উপর এর কী প্রভাব পড়ে - তা তখনই বোঝা যাবে যখন আমরা কর্ম করবো । সমতার পরিচয় কর্ম করাকালেই প্রকাশিত হয় । অর্থাৎ কর্ম করার সময়ে যদি আমাদের মধ্যে সমত্বের ভাব থাকে, অনুরাগ বা বিদ্বেষ না হয়, তাহলে ঠিক আছে ; সেই কর্ম তখন ‘যোগে’র কারণ হয়ে যায় । কিন্তু যদি আমাদের মধ্যে সমত্ব না থাকে, অনুরাগ বা বিদ্বেষ উৎপন্ন হয় ; তাহলে জড়ত্বের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় সেই কর্ম ‘যোগে’র কারণ হয় না ।
আদালতে বিচারক যদি শুধুমাত্র কর্তব্যবোধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করেন, সেখানে যদি তার কোন ব্যক্তিগত লাভ বা বিদ্বেষ না থাকে, তাহলে তিনি সেখানে নির্লিপ্ত থেকে তার সেই কর্মকেই যোগে পরিণত করতে পারেন । বিশ্বকবি বলেছেন -
‘দণ্ডিতের সাথে, দণ্ডদাতা কাঁদে
যবে সমান আঘাতে,
বিচার বলি যে তারে ।’
নানক কান্তি সেন
গীতার প্রথম ষটককে আচার্যপাদেরা কর্মের ষটক নামে অভিহিত করেছেন । ষটকটি শুরু হয়েছে অর্জুনবিষাদযোগ দিয়ে । শত্রæতাপন বীর অর্জুন বিষাদগ্রস্ত । যুদ্ধক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়-¯^জন ও গুরুজনদেরকে বিপক্ষে দেখে অর্জুন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছেন । ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ন্যায়যুদ্ধ করাটাও কর্তব্যকর্ম । অর্জুন সেই ভুমিকা থেকে ভ্রষ্ট । আমরাও হই । সংসারে নানাভাবে আমরা বিষাদগ্রস্ত হই । কিন্তু আমাদের বিষাদ যোগে পরিণত হয় না । অর্জুনের হয়েছে । কারণ অর্জুন তাঁরই সামনে বিষাদগ্রস্ত হয়ে চোখের জল ফেলছেন যিনি এ জগতের সবার বিষাদ দুর করতে সমর্থ । তাই তার বিষাদ যোগে পরিণত হয়ে গেছে । আর আমরা ? আমরা কি কখনও তাঁর সামনে কেঁদেছি, ব্যক্ত করেছি আমাদের বিষণœতা ? উল্টো আমরাই যাই অন্যের চোখের জল মোছাতে । কী যোগ্যতা অঅছে আমাদের অন্যের বিষাদ দুর করণের ? নিজেরাই যেখানে প্রতি পলে পলে বিষণœতায় কাঁদছি, সেখানে কোন্ যোগ্যতা রাখি অন্যের বিষণনতার অশ্রæ মুছিয়ে দিতে ? অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হয়ে তার কর্তব্যকর্ম থেকে সরে গেছেন । যে কলুষতা, হৃদয়ের যে ক্ষুদ্র দুর্বলতা, যে অনার্যসুলভতা অর্জুনের বীরত্বকে ক্লীবত্বে পরিণত করে দিয়েছে, সেখান থেকে তাকে তুলে এনে কর্তব্যকর্মে প্রচোদিত করছেন ¯^য়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ । গুরুজনও যদি আততায়ীর ভুমিকায় অবতীর্ণ হন, তিনি যদি পর¯^াপহরণ করেন, তিনি যদি ব্যভিচারী হন, তিনি যদি পরনারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের সহযোগী হন, তিনি যদি পরগৃহে অগ্নিসংযোগের সহচর হন, তবে তিনি বিনা বিচারে বধ্য, শাস্ত্রের এই মহাবাক্য ভুলে গিয়ে এককালের বিশ্ববিজয়ী হিন্দু আজ ক্লীবত্বের দাসত্ব করছে । আজ তারই চোখের সামনে তার নিজের মা-বোন হচ্ছে অন্যের হাতে ধর্ষিত, তার সহায়-সম্পদ জোর করে দখলে নিচ্ছে অন্যেরা আর হিন্দু ক্লীবের মতো বসে বসে চোখের জল ফেলছে । রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন -
“ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা,
হে রুদ্র, নিষ্ঠুর যেন হতে পারি
তথা, তোমার আদেশে ।”
এককালের করিৎকর্মা হিন্দু আজ সেজেছে নিষ্কর্মার ঢেকি । সঠিক কর্তব্যকর্ম থেকে দুরে সরে গিয়ে সস্তাপথে খুঁজছি ¯^র্গে যাবার ঠিকানা কিন্তু এতটাই আহাম্মক আমরা যে একবারও ভেবে দেখছি না ঐ পথে ¯^র্গ পাবার আশা দুরাশাই মাত্র । যে মহাভারতের অন্তর্গত গীতা, সেই মহাভারতেরই একটি পর্বের নাম মহাপ্রস্থানিক পর্ব যেখানে দেখানো হয়েছে কি ভাবে পঞ্চপাণ্ডব ¯^র্গের পথে চলছিলেন কিন্তু দেখা যায় সবাই পথে পড়ে গেলেন, কেবলমাত্র যুধিষ্ঠিরই সশরীরে ¯^র্গে প্রবেশ করলেন । কেন করতে পারলেন যুধিষ্ঠির, একবারও কী সেটা ভেবে দেখেছি আমরা ? আর সেই আমরাই শ্রাদ্ধ বাসরে গীতা পাঠ করে বোকার মত তৃপ্তির ঢেকুর তুলি, সস্তা দামের গীতা বাজার থেকে কিনে এনে জীবনে কোনদিনই গীতা ছুঁয়েও দেখেনি এমন বামুনদের গীতা দান করে গীতার অবমাননার মধ্য দিয়ে ভাবছি পিটতৃপুরুষ কী নির্বিবাদে ¯^র্গে পৌঁছে গেল । যদি হিন্দু আজও মনোযোগ দিয়ে গীতার বাণী শুনে, গীতার মূল প্রতিপাদ্য অনুধাবণ করতে পারে, তবেই প্রতিটি হিন্দু অর্জুনের ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তার হৃতগৌরব পুনরায় অর্জনে সক্ষম হতে পারে ।
গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম সাংখ্যযোগ । এই অধ্যায়েই ভগবান কথা বলা শুরু করেছেন । প্রথম কথাটাই ছিল অর্জুনের প্রতি -
অশৌচ্যের তরে কাঁদ, মুখে বিজ্ঞ বাণী ।
জীবিত ও মৃতে ভেদ, না করেন জ্ঞানী ।।
আমরাও একই ধরণের বিজ্ঞতা দেখাই যত্র তত্র । অন্তরে নেই বিন্দুমাত্র শাস্ত্রের অনুভুতি । একই কথা বলতে শুনি মহাপ্রভুর মুখে -
যেবা মিশ্র চক্রবর্তী ভট্টাচার্য সব ।
তাহানাও নাহি জানে গ্রন্থ অনুভব ।। গ্রন্থের কথা, শাস্ত্রের কথা যথার্থভাবে উপলব্ধি হয় না অনেকেরই । কারণ সৎগুরুর কৃপা, মহৎ জনের কৃপা তদুপরি শাস্ত্রের কৃপা ভিন্ন ভিতরের কথা কারো পক্ষেই উদঘাটন করা সম্ভব নয় । অর্জুন যাঁর কাছ থেকে শুনছেন, তিনি হচ্ছেন জগ˜গুরু ‘কৃষ্ণং বন্দে জগ˜গুরুম্ ।’ অসীম জ্ঞানের উৎস তিনি ।
গীতার ২য় অধ্যায়ের ৪৮নং শ্লোকে বলছেন -
মনে প্রাণে ভগবানে করিয়া আশ্রয় ।
‘যোগস্থ’ হইয়া কর্ম কর ধনঞ্জয় ।।
সিদ্ধি কিংবা অসিদ্ধিতে অচঞ্চল চিত ।
সেই ‘সমজ্ঞান’ যোগ নামেতে কথিত ।।
সংসারের তুচ্ছাতিতুচ্ছ কর্মটাও যোগে পরিণত হয়ে যায় যদি কেউ সর্বকর্মেই তাঁর সাথে নিজেকে যোগ করে দিতে পারে । কোন কর্মে বা কর্মের ফলে, কোন দেশ, কাল, ঘটনা পরিস্থিতি, অন্তঃকরণ,বহিঃকরণ ইত্যাদি প্রাকৃত বস্তুতে আসক্তিরহিত হয়েনির্লিপ্তভাবে কর্ম করে যেতে হবে । সিদ্ধি এবং অসিদ্ধিতে সমজ্ঞান রাখতে হবে । কর্ম সম্পূর্ণ হওয়া বা না হওয়া, জাগতিক দৃষ্টিতে তার ফল অনুকুল হওয়া বা প্রতিকুল হওয়া, ঐ কর্ম করায় প্রশংসা বা নিন্দা হওয়া বা না হওয়া ইত্যাদি যে সমস্ত সিদ্ধি বা অসিদ্ধি আছে, তাতে সম থাকা উচিত, সমান জ্ঞান করা উচিত । কর্মযোগীর সমভাব এমন হওয়া উচিত যাতে কর্ম সম্পন্ন হোক বা না হোক, ফলপ্রাপ্তি হোক বা না হোক, নিজের মুক্তি হোক বা না হোক - আমার কেবল কর্তব্য পালন করে যাওয়াই উচিত ।
তৃতীয় অধ্যায়ের নাম কর্মযোগ । এই অধ্যায়ের ৩০নং শ্লোকে ভগবান বলছেন -
“ময়ি সর্বাণি কর্মাণি সন্ন্যাধ্যাত্মচেতসা ।
নিরাশীনির্মমো ভুত্বা যুধ্য¯^ বিগতজ্বরঃ ।।
সর্বকর্ম আমাতেই করি সর্বক্ষণ ।
আমার আজ্ঞায় কর্ম কর সমর্পণ ।।
এই জ্ঞানে মায়া-মোহ ত্যজি শোক ভয় ।
অনাসক্ত চিত্তে যুদ্ধ কর ধনঞ্জয় ।।
প্রকৃতপক্ষে জগতের সমস্ত ক্রিয়াই কেবলমাত্র ভগবানের শক্তিতেই হয়ে থাকে । শরীর ইন্দ্রিয়াদি, পদার্থ ইত্যাদিও ভগবানের এবং শক্তিও তাঁরই । এজন্য সবকিছুই ভগবানের এবং ভগবান্ আমার - গভীরভাবে এই বিচার করে যখন তুমি কর্তব্যকর্ম করবে, তখন ঐ কর্মগুলি আর তোমার বন্ধনকারক হবে না বরং মুক্তিদায়ক হয়ে উঠবে । সেইজন্য যে সমস্ত কর্তব্যকর্ম এসে উপস্থিত হয়, সেগুলি নিষ্কাম, মমত্বহীন এবং নিঃসন্তাপ হয়ে ভগবদর্পণ বুদ্ধিতে করা উচিত ।
ষটকটির ৪র্থ অধ্যায় জ্ঞানযোগ । ঐ অধ্যায়ের ৪১নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“যোগসন্ন্যস্তকর্মাণং জ্ঞানসংচ্ছিন্নসংশয়ম্ ।
আত্মবন্তং ন কর্মাণি নিবধœন্তি ধনঞ্জয় ।।”
ঈশ্বরে অর্পিত কর্ম, জ্ঞানে অসংশয় ।
আত্মজ্ঞানী কর্মে বদ্ধ নহে ধনঞ্জয় ।।
জগতে দিনরাত নানাপ্রকার কর্ম সংঘটিত হচ্ছে, কিন্তু সেসব কর্মে আমাদের আসক্তি বা অনুরাগ না থাকায় আমরা সে সকল কর্ম দ্বারা আবদ্ধ হই না, নির্লিপ্ত থাকি । যে সব কর্মে আমাদের অনুরাগ বা আসক্তি আসে, সেই কর্ম দ্বারা আমরা আবদ্ধ হই, কারণ রাগ-দ্বেষের দ্বারাই কর্মের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্থাপিত হয় । যখন রাগ-দ্বেষ থাকে না অর্থাৎ সমত্ববোধ জাগ্রত হয়, তখন কর্মের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হয় না ; অতএব মানুষ কর্মবন্ধন হতে মুক্ত হয়ে যায় ।
ষটকটির ৫ম অধ্যায় হলো কর্মসন্ন্যাসযোগ । এই অধ্যায়ের ১০নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত¦া করোতি যঃ ।
লিপ্যতে ন স পাপেন পদ্মপত্রমিবাম্ভসা ।।”
ব্রহ্মে সমর্পিয়া, ফল তেয়াগিয়া, কর্ম করে যেই জন ।
সে নহে কখন, পাপে নিমগণ, পদ্মে সলিল যেমন ।।
শরীর, ইন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, প্রাণ ইত্যাদি সবকিছু ভগবানেরই, নিজের নয় । সুতরাং এদের দ্বারা হওয়া ক্রিয়াগুলিকে ভক্তিযোগী কী করে নিজের বলে মনে করবেন ? সেজন্য তাঁর এই ভাব থাকে, ‘ক্রিয়ামাত্রই ভগবানের দ্বারা এবং ভগবানের জন্যই হচ্ছে, আমি তো নিমিত্তমাত্র ।’
ভগবানই আমার ইন্দ্রিয়ের দ্বারা নিজেই সব ক্রিয়া করছেন - এ কথাটি ঠিকভাবে উপলব্ধি করে সমস্ত ক্রিয়াগুলির কর্তা ভগবান এরূপ ¯^ীকার করা হল ‘ব্রহ্মণ্যাধায় কর্মাণি’ ।
এটি অত্যন্ত লক্ষণীয় বিষয় যে, ভগবানের শরণাগত হয়ে ভক্তিযোগী সংসারে থেকে ভগবানে নিবেদিতভাবে কর্মসম্পন্ন করলে কর্ম দ্বারা বন্ধনপ্রাপ্ত হন না । যেমন পদ্মপাতা জলে উৎপন্ন হয়ে, জলে থেকেও জল থেকে নির্লিপ্ত থাকে, তেমনি ভক্তিযোগী সংসারে থেকে সমস্ত ক্রিয়া করলেও ভগবানের শরণাগত হওয়ায় সংসারে সর্বদা সর্বতোভাবে নির্লিপ্ত থাকেন । একই কথা বলেছিলেন মহাপ্রভু সপ্তগ্রামের জমিদার হিরণ্য-গোবর্ধনের পুত্র রঘুনাথকে । রঘুনাথ যখন সংসার থেকে পালিয়ে মহাপ্রভুর কাছে গেলেন বৈরাগ্যমন্ত্রে দীক্ষিত হতে, তখন মহাপ্রভু তাঁকে বলেছিলেন, ‘গৃহে ফিরে যাও রঘুনাথ -
মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া ।
যথাশক্তি বিষয় ভুঞ্জ অনাসক্তি হঞা ।।
অন্তরে নিষ্ঠা কর, বাহ্যে লোক-ব্যবহার ।
অচিরাতে কৃষ্ণ তোমা করিবে উদ্ধার ।।
ভগবানের প্রতি বিমুখ হয়ে সংসারের কামনা করাই সমস্ত পাপের প্রধান কারণ । কামনা উৎপন্ন হয় আসক্তি থেকে । আসক্তি সর্বতোভাবে দুর হলে কামনা থাকে না । তাই পাপ হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে না ।
কর্মষটকের শেষ অধ্যায় হলো অভ্যাসযোগ । এই অধ্যায়ের ৩নং শ্লোকে ভগবান্ বলছেন -
“আরুরুক্ষোর্মুনের্যোগং কর্ম কারণমুচ্যতে ।
যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে ।।”
কর্মই জ্ঞান, কর্মই সাধনা যে জানে ।
সমাধি লভে সেজন কর্ম-অবসানে ।।
ফল প্রাপ্তিতে আমাদের সমতা আছে কি নেই, আমাদের উপর এর কী প্রভাব পড়ে - তা তখনই বোঝা যাবে যখন আমরা কর্ম করবো । সমতার পরিচয় কর্ম করাকালেই প্রকাশিত হয় । অর্থাৎ কর্ম করার সময়ে যদি আমাদের মধ্যে সমত্বের ভাব থাকে, অনুরাগ বা বিদ্বেষ না হয়, তাহলে ঠিক আছে ; সেই কর্ম তখন ‘যোগে’র কারণ হয়ে যায় । কিন্তু যদি আমাদের মধ্যে সমত্ব না থাকে, অনুরাগ বা বিদ্বেষ উৎপন্ন হয় ; তাহলে জড়ত্বের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ায় সেই কর্ম ‘যোগে’র কারণ হয় না ।
আদালতে বিচারক যদি শুধুমাত্র কর্তব্যবোধে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করেন, সেখানে যদি তার কোন ব্যক্তিগত লাভ বা বিদ্বেষ না থাকে, তাহলে তিনি সেখানে নির্লিপ্ত থেকে তার সেই কর্মকেই যোগে পরিণত করতে পারেন । বিশ্বকবি বলেছেন -
‘দণ্ডিতের সাথে, দণ্ডদাতা কাঁদে
যবে সমান আঘাতে,
বিচার বলি যে তারে ।’
Comments
Post a Comment