অঙ্গারং শতধৌতেন মলিনত্বং ন মুঞ্চতে
নানক কান্তি সেন
প্রবাদবাক্যটি মনে এল হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রতিদিনের বাণী’ পত্রিকায় ৩১ মার্চ, ২০১৮খ্রি.-তে প্রকাশিত ‘অশৌচ ও শ্রাদ্ধ বিষয়ে বিভ্রান্তির চির অবসান চাই’ ও ২১ মে, ২০১৮খ্রি.-তে প্রকাশিত ‘সনাতন ধর্মে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ ও বর্জন প্রসঙ্গে’ দু দুটি প্রবন্ধ দেখে । উভয়টিই ‘পণ্ডিতস্মণ্য করুণাময় চক্রবরÍী’র দিগগজ বিদ্যার ফসল । কেন ঐ প্রবন্ধদ্বয় পড়ে উপরোক্ত আপ্তবাক্যটি মনে পড়লো, সেটা খুলে বলি ।
একবার ব্রহ্মার অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র শূকর-যোনিতে জন্ম নিল । বহুদিন পর দেবর্ষি নারদ সেদিক দিয়ে যাচ্ছেন যেদিকের এক স্থানে শূকররূপী ইন্দ্র তার কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে কাদায় মহানন্দে গড়াগড়ি দিচ্ছে । শূকর তার পূর্বজন্মের কথা ভুললেও দেবর্ষি কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছেন । দেবর্ষি তখন ডেকে বলছেন, “এই শূকর, ¯^র্গে যাবে ?” তখন শূকররূপী ইন্দ্র সেখান থেকে উত্তর দিচ্ছে, “দেবর্ষি, তুমি যে ¯^র্গের লোভ দেখাচ্ছ, সেখানে কী এখানকার মত সুখ আছে ?” এটিই হয় । আপনি যতই শূকরকে পরিপাটি রাখতে চেষ্টা করুন না কেন, সে কাদায় গড়াগড়ি দেবেই । সব পণ্ড করা পণ্ডিতের ও দুটি প্রবন্ধ পড়ে সেটাই মনে আসছিল ।
তাছাড়া ভাগবতের দিকে লক্ষ্য করুন । শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ভগবান্ শিব এবং দক্ষ প্রজাপতির মনোমালিন্য’ বিষয়ে দেখা যায় দেব-সভায় দক্ষ যখন শিবনিন্দা ও শিবকে অভিসম্পাত করে ক্রোধে সভাস্থল পরিত্যাগ করে চলে গেলেন, তখন মহাদেবের প্রধান অনুচর নন্দীশ্বর ক্রোধে যেসব ব্রাহ্মণ দক্ষ এবং তাঁর শিবনিন্দা সমর্থন করেছিলেন তাদের সকলকে ভয়ঙ্কর অভিশাপ দিলেন ।
“য এতন্মর্ত্যমুদ্দিশ্য ভগবত্যপ্রতিদ্রুহি ।
দ্রুহ্যত্যজ্ঞঃ পৃথগ্ দৃষ্টিস্তত্ত¡তো বিমুখো ভবেৎ ।।
গৃহেষু কূটধর্মেষু সক্তো গ্রাম্যসুখেচ্ছয়া ।
কর্মতন্ত্রং বিতনুতে বেদবাদবিপন্নধীঃ ।।
বুদ্ধ্যা পরাভিধ্যায়িন্যা বিস্মৃতাত্মগতিঃ পশুঃ ।
স্ত্রীকামঃ সোহস্ত¡তিতরাং দক্ষো বস্তমুখোহচিরাৎ ।।
বিদ্যাবুদ্ধিরবিদ্যায়াং কর্মময্যামসৌ জড়ঃ ।
সংসারন্তি¦হ যে চামুমনু শর্বাবমানিনম্ ।।
গিরঃ শ্রæতায়াঃ পুষ্পিণ্যা মধুগন্ধেন ভূরিণা ।
মথœা চোন্মথিতাত্মানঃ সম্মুহ্যন্তু হরদ্বিষঃ ।।
সর্বভক্ষা দ্বিজা বৃত্ত্যৈ ধৃতবিদ্যাতপোব্রতাঃ ।
বিত্তদেহেন্দ্রিয়ারামা যাচকা বিচরন্তি¦হ ।।”
- ( ভাঃ ৪/২/২১-২৬)
- নন্দীশ্বর বললেন, “যে এই মরণশীল শরীরের কারণে গর্বযুক্ত হয়ে - যিনি অপরের দ্রোহের পাত্র ( অন্যের দ্বারা অপকৃত ) হয়েও ( প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ) তার প্রতি দ্রোহমূলক আচরণ করেন না - সেই ভগবান শংকরকে দ্বেষ করে, সেই ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মূর্খ দক্ষ কখনই তত্ত¡জ্ঞান লাভ করতে পারবে না । (‘চাতুর্মাস্য-যাগকারীর অক্ষয় পূণ্য হয়’ ইত্যাদি অর্থবাদরূপী ) বেদবাক্যসমূহের দ্বারা মোহিত এবং বিবেকভ্রষ্ট হয়ে এই দক্ষ বিষয়সুখ ভেগের ইচ্ছায় কপট ধর্মময় গৃহস্থাশ্রমে আসক্ত থেকে কেবলমাত্র কর্মকাণ্ডেরই বিস্তার করে চলেছে । দেহাদিকেই আত্মা বলে ধারণা করছে । আর সেই বুদ্ধির প্রভাবে এ আত্মতত্ত¡ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছে, সুতরাং এ সাক্ষাৎ পশুতুল্যই হয়ে গেছে । এ ( পশুরই মতো ) নিতান্ত স্ত্রীকামুক হোক এবং এর মুখটি অচিরাৎ ছাগলের মুখে পরিণত হোক । এই মূর্খ কর্মকাণ্ডবহুল অবিদ্যাকেই বিদ্যা বলে ধারণা করেছে সেই কারণে এই শিবাবমাননাকারী দুর্মতি দক্ষ এবং তার অনুসারী সকলেই জন্মমরণরূপ সংসারচক্রে আবদ্ধ হয়ে থাকুক । বেদবাণীরূপ লতা ফলশ্রæতিরূপ পুষ্পে সুশোভিত, তার কর্মফলরূপ মনোমোহকর গন্ধে এদের চিত্ত উন্মথিত হয়ে রয়েছে সেইহেতু এই শিব বিদ্বেষীরা কর্মাসক্তির কঠিন বন্ধনে জড়িত এবং বিভ্রান্ত হয়ে থাকুক । এই ব্রাহ্মণরা খাদ্যাখাদ্যের বিচারশূণ্য হয়ে কেবলমাত্র উদরপূর্তির জন্যই বিদ্যা, তপস্যা ও ব্রতপালনাদি আশ্রয় করুক এবং ধনসম্পদ, দেহ এবং ইন্দ্রিয়ের সুখকেই একমাত্র সুখ মনে করে - এগুলিরই ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে সর্বদাই ভিক্ষা-প্রত্যাশী হয়ে এই সংসারে বিচরণ করুক ।” নন্দীশ্বরের অভিশাপের প্রতিফলন দেখতে পাই পণ্ডিতস্মণ্য চক্রবর্তীর প্রবন্ধ-দ্বয়ে এবং এদের আচরণের মধ্য দিয়ে ।
শ্রীচৈতন্যভাগবতে শ্রীল বৃন্দাবনদাস ঠাকুর লিখেছেন -
- “এ সকল রাক্ষস ব্রাহ্মণ নামমাত্র ।
- এইসব জনা যম-যাতনার পাত্র ।।
- কলিযুগে রাক্ষস সকল বিপ্রঘরে ।
- জন্মিবেক সুজনের হিংসা করিবারে ।।
- এ সব বিপ্রের স্পর্শ কথা নমস্কার ।
- ধর্ম শাস্ত্রে সর্বদা নিষেধ করিবার ।।
- ব্রাহ্মণ হইয়া যদি অবৈষ্ণব হয় ।
- তবে তার আলাপনে পূণ্য যায় ক্ষয় ।।”
- - (আদিখণ্ড, চতুর্দশ অধ্যায়)
জয়ানন্দ লিখেছেন চৈতন্যমঙ্গলে -
- “¯œান সন্ধ্যা দেবার্চনা ছাড়িল ব্রাহ্মণে ।
- শূদ্রের জীবিকা করে ভয় নাহি মনে ।।
- শূদ্র স্ত্রী সঙ্গম করে, শূদ্র ভক্ষ্যে রত ।
- মৎস্য মাংস লোলুপাদি ব্রাহ্মণ সব যত ।।”
এসব সাধক পুরুষদের শাস্ত্রনির্ভর কথা যে কতখানি বাস্তবসম্মত তা করুণাময় চক্রবর্তীদের মত অভিমানী পণ্ডিতস্মণ্যদের নিত্য আচরণ দেখলেই স্পষ্ট হয়ে উঠে ।
ত্রেতাযুগে যখন বিভীষণ রাবণ কর্তৃক তীরস্কৃত হয়ে ভগবান্ রামচন্দ্রের নিকট আসছিল, তাকে অঅসতে দেখে ল²ণ রামকে বলেছিলেন, “দাদা, তোমার ত আবার এক মহান গুণ, কেউ ডাকলেই গলে পর । দেখ, ঐ রাক্ষস বেটা আসছে, দেখ আবার তার কথায় গলে যেও না ।” উত্তরে রাম বলছেন, “না ভাই, বিভীষণ আমার প্রিয় ভক্ত ।” ল²ণ বলছেন, “বাহ্, ভেবেছিলাম, ডাকলে পরে গলতে পার, এখন দেখছি ডাকার আগেই গলে পড়ে গেছ ।” এসব কথা বিভীষণের কানে যেতেই বিভীষণ ল²ণকে বলছেন, “তাত, যদি আমি আমার প্রভুর প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষভাব হৃদে পোষণ করে থাকি, তাহলে আমি তিনটি বর চাইছি, সেগুলি যেন লাভ করি ।” ল²ণ বলছেন, “কি বর ?” বিভীষণ বলছেন, “ আমি যেন প্রথম বরে কলিযুগে রাজা হয়ে জন্মাই ।” “বেশ বেশ, দ্বিতীয় বর ?”, ল²ণ শুধালেন । বিভীষণ উত্তর দিলেন, “দ্বিতীয় বরে আমি যেন শত পুত্রের জনক হই ।” “আর তৃতীয়টি ?”, ল²ণ পুনঃ শুধালেন । বিভীষণ বললেন, তৃতীয় বরে অঅমি যেন কলিযুগে ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করি ।” সব শুনে ল²ণ রামচন্দ্রকে বলছেন, “দেখলে দাদা, আমি প্রথমেই বলেছিলাম, রাক্ষস বেটা কোন অভিসন্ধি নিয়ে এসেছে, এখন পেলে তো ?” রামচন্দ্র বলছেন, “লক্ষ্ণ, তুমি বাইরের দিকটাই দেখতে পাচ্ছ, ভিতরের মূল তত্ত¡টাই বুঝতে পারনি । শুন ল²ণ, বিভীষণ এমন এক যুগে রাজা হতে চাইছে যে যুগে রাজ-সম্মান বলে কোন কিছুই থাকবে না । প্রজারা রাজাদের ইচ্ছামত নাচাবে । দ্বিতীয়ত সে এমন এক যুগে শত পুত্রের জনক হতে চাইছে যে যুগে একটা সন্তানকে মানুষ রূপে গড়ে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে, সে সেখানে নিতে চাইছে শত পুত্রের দায়ীত্ব । তৃতীয়ত, এই যে রাক্ষসকুলকে দেখছ, এরাই কলিযুগে বিপ্রঘরে গিয়ে জন্ম নেবে এব্ং বেদের দোহাই দিয়ে কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়ে লোককে বিপথগামী করবে । এরা ত আমাকে কোনদিনই পাবে না এমনকি এদের অনুসরণকারীরাও আমাকে কোনদিন পাবে না । এরা থাকবে আমা থেকে সহ¯্র যোজন দুরে ।”
পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে বলা আছে, এসব ব্রাহ্মণদের দেখলে সাথে সাথে ¯œান করতে হয় । মহাদেব পার্বতীকে বলছে, “হে বরাননে ! ব্রাহ্মণ যদি বৈষ্ণব না হয়, তবে তার সাথে আলাপ দুরে থাকুক, তাতে দর্শন করাটাও নীতিশাস্ত্রে নিষেধ ।”
সুতরাং করুণাময় চক্রবর্তীদের মত অহঙ্কারী অভিমানী জাতবেপারি পণ্ডিতস্মণ্যরা যে মহাপ্রভুর আদর্শ বিরোধী হয়ে নিরয়গামী শাস্ত্রবাক্য দিয়ে সমাজকে বিভ্রান্ত করবেন, এটাে খুবই ¯^াভাবিক ।
এরা দেখতে পায় না ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কী লিখা আছে,
“অশ্বালম্ভং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্ ।
দেবরেণ সুতোৎপাদন কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ ।।”
অশ্বমেধ যজ্ঞ, গোমেধ যজ্ঞ, সন্ন্যাস, মাছ-মাংস দ্বারা পিতৃ-পুরুষের শ্রাদ্ধ, ও দেবর দ্বারা সন্তান উৎপাদন - এই পাঁচটি কর্ম কলিযুগে নিষেধ করা হয়েছে ।
করুণাময় চক্রবর্তী মহোদয়ের মত যারা শ্রাদ্ধবাসরে মাছ-মাংস আহার করেন, তারা নিশ্চয়ই বাকী কাজগুলিও করেন, তাদের পক্ষেই সম্ভব দেবর দ্বারা নিজের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনেরও ।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে সপ্তবিংশ অধ্যায়ে বলছেন, -
সকল দেশে সকল ব্রাহ্মণেরই তাল, মসুর ও মৎস্য পরিত্যাজ্য । ব্রাহ্মণ ইচ্ছাক্রমে মৎস্য ভোজন করলে ত্রিরাত্রি উপবাস ও প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধিলাভ করবেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতে দেবর্ষি নারদ বলছেন -
“দেশে কালে চ সম্প্রাপ্তে মুন্যন্নং হরিদৈবতম্ ।
শ্রদ্ধয়া বিধিবৎ পাত্রে ন্যস্তং কামধুগক্ষয়ম্ ।।
দেবর্ষিপিতুভুতেভ্য আত্মনে সৃজনায় চ ।
অন্নং সংবিভজন্ পশ্যেৎ সর্ব্বং তৎ পুরুষাত্মকম্ ।।
ন দদ্যাদামিষং শ্রাদ্ধে ন চাদ্যাদবধর্মতত্ত¡বিৎ ।
মুন্যন্নৈঃ স্যাৎ পরা প্রীতির্যথা ন পশুহিংসন্না ।।”
- ( ভাঃ ৭/১১/৫-৭ )
শ্রাদ্ধোচিত দেশ এবং কাল প্রাপ্ত হলে নীবারাদি নিস্পাদিত-বিষ্ণুদৈবত অন্ন শ্রদ্ধা সহকারে যথাবিধি সুপাত্রে অর্পিত হলে তা ঈপ্সিত বস্তু প্রদান করে এবং অক্ষয় হয় । দেব, ঋষি, পিতৃগণ, তির্য্যগাদি জীব, ¯^য়ং ও ¯^জনাদির উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে অন্ন বিভাগ করে দিয়ে সকলকেই নারায়ণ¯^রূপ দেখবে । ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি শ্রাদ্ধে আমিষ দ্রব্য দেবেন না এবং তা ভোজনও করবেন না । নিরামিষ নীবারাদির অন্নে শ্রাদ্ধীয় দেবতার যেরূপ প্রীতি জন্মে থাকে, পশুহিংসা অর্থাৎ আমিষ দ্বারা সেরূপ প্রীতি সাধিত হয় না ।
অবশ্য তামসিক ও আসুরিক ভাব সম্পন্ন লোকদের এসব কথা দৃষ্টিগোচর না হওয়াই ¯^াভাবিক ।
নানক কান্তি সেন
প্রবাদবাক্যটি মনে এল হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত পত্রিকা ‘প্রতিদিনের বাণী’ পত্রিকায় ৩১ মার্চ, ২০১৮খ্রি.-তে প্রকাশিত ‘অশৌচ ও শ্রাদ্ধ বিষয়ে বিভ্রান্তির চির অবসান চাই’ ও ২১ মে, ২০১৮খ্রি.-তে প্রকাশিত ‘সনাতন ধর্মে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ ও বর্জন প্রসঙ্গে’ দু দুটি প্রবন্ধ দেখে । উভয়টিই ‘পণ্ডিতস্মণ্য করুণাময় চক্রবরÍী’র দিগগজ বিদ্যার ফসল । কেন ঐ প্রবন্ধদ্বয় পড়ে উপরোক্ত আপ্তবাক্যটি মনে পড়লো, সেটা খুলে বলি ।
একবার ব্রহ্মার অভিশাপে দেবরাজ ইন্দ্র শূকর-যোনিতে জন্ম নিল । বহুদিন পর দেবর্ষি নারদ সেদিক দিয়ে যাচ্ছেন যেদিকের এক স্থানে শূকররূপী ইন্দ্র তার কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে কাদায় মহানন্দে গড়াগড়ি দিচ্ছে । শূকর তার পূর্বজন্মের কথা ভুললেও দেবর্ষি কিন্তু ঠিকই চিনতে পেরেছেন । দেবর্ষি তখন ডেকে বলছেন, “এই শূকর, ¯^র্গে যাবে ?” তখন শূকররূপী ইন্দ্র সেখান থেকে উত্তর দিচ্ছে, “দেবর্ষি, তুমি যে ¯^র্গের লোভ দেখাচ্ছ, সেখানে কী এখানকার মত সুখ আছে ?” এটিই হয় । আপনি যতই শূকরকে পরিপাটি রাখতে চেষ্টা করুন না কেন, সে কাদায় গড়াগড়ি দেবেই । সব পণ্ড করা পণ্ডিতের ও দুটি প্রবন্ধ পড়ে সেটাই মনে আসছিল ।
তাছাড়া ভাগবতের দিকে লক্ষ্য করুন । শ্রীমদ্ভাগবতের চতুর্থ স্কন্ধের দ্বিতীয় অধ্যায়ে ‘ভগবান্ শিব এবং দক্ষ প্রজাপতির মনোমালিন্য’ বিষয়ে দেখা যায় দেব-সভায় দক্ষ যখন শিবনিন্দা ও শিবকে অভিসম্পাত করে ক্রোধে সভাস্থল পরিত্যাগ করে চলে গেলেন, তখন মহাদেবের প্রধান অনুচর নন্দীশ্বর ক্রোধে যেসব ব্রাহ্মণ দক্ষ এবং তাঁর শিবনিন্দা সমর্থন করেছিলেন তাদের সকলকে ভয়ঙ্কর অভিশাপ দিলেন ।
“য এতন্মর্ত্যমুদ্দিশ্য ভগবত্যপ্রতিদ্রুহি ।
দ্রুহ্যত্যজ্ঞঃ পৃথগ্ দৃষ্টিস্তত্ত¡তো বিমুখো ভবেৎ ।।
গৃহেষু কূটধর্মেষু সক্তো গ্রাম্যসুখেচ্ছয়া ।
কর্মতন্ত্রং বিতনুতে বেদবাদবিপন্নধীঃ ।।
বুদ্ধ্যা পরাভিধ্যায়িন্যা বিস্মৃতাত্মগতিঃ পশুঃ ।
স্ত্রীকামঃ সোহস্ত¡তিতরাং দক্ষো বস্তমুখোহচিরাৎ ।।
বিদ্যাবুদ্ধিরবিদ্যায়াং কর্মময্যামসৌ জড়ঃ ।
সংসারন্তি¦হ যে চামুমনু শর্বাবমানিনম্ ।।
গিরঃ শ্রæতায়াঃ পুষ্পিণ্যা মধুগন্ধেন ভূরিণা ।
মথœা চোন্মথিতাত্মানঃ সম্মুহ্যন্তু হরদ্বিষঃ ।।
সর্বভক্ষা দ্বিজা বৃত্ত্যৈ ধৃতবিদ্যাতপোব্রতাঃ ।
বিত্তদেহেন্দ্রিয়ারামা যাচকা বিচরন্তি¦হ ।।”
- ( ভাঃ ৪/২/২১-২৬)
- নন্দীশ্বর বললেন, “যে এই মরণশীল শরীরের কারণে গর্বযুক্ত হয়ে - যিনি অপরের দ্রোহের পাত্র ( অন্যের দ্বারা অপকৃত ) হয়েও ( প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে ) তার প্রতি দ্রোহমূলক আচরণ করেন না - সেই ভগবান শংকরকে দ্বেষ করে, সেই ভেদবুদ্ধিসম্পন্ন মূর্খ দক্ষ কখনই তত্ত¡জ্ঞান লাভ করতে পারবে না । (‘চাতুর্মাস্য-যাগকারীর অক্ষয় পূণ্য হয়’ ইত্যাদি অর্থবাদরূপী ) বেদবাক্যসমূহের দ্বারা মোহিত এবং বিবেকভ্রষ্ট হয়ে এই দক্ষ বিষয়সুখ ভেগের ইচ্ছায় কপট ধর্মময় গৃহস্থাশ্রমে আসক্ত থেকে কেবলমাত্র কর্মকাণ্ডেরই বিস্তার করে চলেছে । দেহাদিকেই আত্মা বলে ধারণা করছে । আর সেই বুদ্ধির প্রভাবে এ আত্মতত্ত¡ সম্পূর্ণরূপে বিস্মৃত হয়েছে, সুতরাং এ সাক্ষাৎ পশুতুল্যই হয়ে গেছে । এ ( পশুরই মতো ) নিতান্ত স্ত্রীকামুক হোক এবং এর মুখটি অচিরাৎ ছাগলের মুখে পরিণত হোক । এই মূর্খ কর্মকাণ্ডবহুল অবিদ্যাকেই বিদ্যা বলে ধারণা করেছে সেই কারণে এই শিবাবমাননাকারী দুর্মতি দক্ষ এবং তার অনুসারী সকলেই জন্মমরণরূপ সংসারচক্রে আবদ্ধ হয়ে থাকুক । বেদবাণীরূপ লতা ফলশ্রæতিরূপ পুষ্পে সুশোভিত, তার কর্মফলরূপ মনোমোহকর গন্ধে এদের চিত্ত উন্মথিত হয়ে রয়েছে সেইহেতু এই শিব বিদ্বেষীরা কর্মাসক্তির কঠিন বন্ধনে জড়িত এবং বিভ্রান্ত হয়ে থাকুক । এই ব্রাহ্মণরা খাদ্যাখাদ্যের বিচারশূণ্য হয়ে কেবলমাত্র উদরপূর্তির জন্যই বিদ্যা, তপস্যা ও ব্রতপালনাদি আশ্রয় করুক এবং ধনসম্পদ, দেহ এবং ইন্দ্রিয়ের সুখকেই একমাত্র সুখ মনে করে - এগুলিরই ক্রীতদাসে পরিণত হয়ে সর্বদাই ভিক্ষা-প্রত্যাশী হয়ে এই সংসারে বিচরণ করুক ।” নন্দীশ্বরের অভিশাপের প্রতিফলন দেখতে পাই পণ্ডিতস্মণ্য চক্রবর্তীর প্রবন্ধ-দ্বয়ে এবং এদের আচরণের মধ্য দিয়ে ।
শ্রীচৈতন্যভাগবতে শ্রীল বৃন্দাবনদাস ঠাকুর লিখেছেন -
- “এ সকল রাক্ষস ব্রাহ্মণ নামমাত্র ।
- এইসব জনা যম-যাতনার পাত্র ।।
- কলিযুগে রাক্ষস সকল বিপ্রঘরে ।
- জন্মিবেক সুজনের হিংসা করিবারে ।।
- এ সব বিপ্রের স্পর্শ কথা নমস্কার ।
- ধর্ম শাস্ত্রে সর্বদা নিষেধ করিবার ।।
- ব্রাহ্মণ হইয়া যদি অবৈষ্ণব হয় ।
- তবে তার আলাপনে পূণ্য যায় ক্ষয় ।।”
- - (আদিখণ্ড, চতুর্দশ অধ্যায়)
জয়ানন্দ লিখেছেন চৈতন্যমঙ্গলে -
- “¯œান সন্ধ্যা দেবার্চনা ছাড়িল ব্রাহ্মণে ।
- শূদ্রের জীবিকা করে ভয় নাহি মনে ।।
- শূদ্র স্ত্রী সঙ্গম করে, শূদ্র ভক্ষ্যে রত ।
- মৎস্য মাংস লোলুপাদি ব্রাহ্মণ সব যত ।।”
এসব সাধক পুরুষদের শাস্ত্রনির্ভর কথা যে কতখানি বাস্তবসম্মত তা করুণাময় চক্রবর্তীদের মত অভিমানী পণ্ডিতস্মণ্যদের নিত্য আচরণ দেখলেই স্পষ্ট হয়ে উঠে ।
ত্রেতাযুগে যখন বিভীষণ রাবণ কর্তৃক তীরস্কৃত হয়ে ভগবান্ রামচন্দ্রের নিকট আসছিল, তাকে অঅসতে দেখে ল²ণ রামকে বলেছিলেন, “দাদা, তোমার ত আবার এক মহান গুণ, কেউ ডাকলেই গলে পর । দেখ, ঐ রাক্ষস বেটা আসছে, দেখ আবার তার কথায় গলে যেও না ।” উত্তরে রাম বলছেন, “না ভাই, বিভীষণ আমার প্রিয় ভক্ত ।” ল²ণ বলছেন, “বাহ্, ভেবেছিলাম, ডাকলে পরে গলতে পার, এখন দেখছি ডাকার আগেই গলে পড়ে গেছ ।” এসব কথা বিভীষণের কানে যেতেই বিভীষণ ল²ণকে বলছেন, “তাত, যদি আমি আমার প্রভুর প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষভাব হৃদে পোষণ করে থাকি, তাহলে আমি তিনটি বর চাইছি, সেগুলি যেন লাভ করি ।” ল²ণ বলছেন, “কি বর ?” বিভীষণ বলছেন, “ আমি যেন প্রথম বরে কলিযুগে রাজা হয়ে জন্মাই ।” “বেশ বেশ, দ্বিতীয় বর ?”, ল²ণ শুধালেন । বিভীষণ উত্তর দিলেন, “দ্বিতীয় বরে আমি যেন শত পুত্রের জনক হই ।” “আর তৃতীয়টি ?”, ল²ণ পুনঃ শুধালেন । বিভীষণ বললেন, তৃতীয় বরে অঅমি যেন কলিযুগে ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করি ।” সব শুনে ল²ণ রামচন্দ্রকে বলছেন, “দেখলে দাদা, আমি প্রথমেই বলেছিলাম, রাক্ষস বেটা কোন অভিসন্ধি নিয়ে এসেছে, এখন পেলে তো ?” রামচন্দ্র বলছেন, “লক্ষ্ণ, তুমি বাইরের দিকটাই দেখতে পাচ্ছ, ভিতরের মূল তত্ত¡টাই বুঝতে পারনি । শুন ল²ণ, বিভীষণ এমন এক যুগে রাজা হতে চাইছে যে যুগে রাজ-সম্মান বলে কোন কিছুই থাকবে না । প্রজারা রাজাদের ইচ্ছামত নাচাবে । দ্বিতীয়ত সে এমন এক যুগে শত পুত্রের জনক হতে চাইছে যে যুগে একটা সন্তানকে মানুষ রূপে গড়ে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াবে, সে সেখানে নিতে চাইছে শত পুত্রের দায়ীত্ব । তৃতীয়ত, এই যে রাক্ষসকুলকে দেখছ, এরাই কলিযুগে বিপ্রঘরে গিয়ে জন্ম নেবে এব্ং বেদের দোহাই দিয়ে কর্মকাণ্ডের প্রসার ঘটিয়ে লোককে বিপথগামী করবে । এরা ত আমাকে কোনদিনই পাবে না এমনকি এদের অনুসরণকারীরাও আমাকে কোনদিন পাবে না । এরা থাকবে আমা থেকে সহ¯্র যোজন দুরে ।”
পদ্মপুরাণের উত্তরখণ্ডে বলা আছে, এসব ব্রাহ্মণদের দেখলে সাথে সাথে ¯œান করতে হয় । মহাদেব পার্বতীকে বলছে, “হে বরাননে ! ব্রাহ্মণ যদি বৈষ্ণব না হয়, তবে তার সাথে আলাপ দুরে থাকুক, তাতে দর্শন করাটাও নীতিশাস্ত্রে নিষেধ ।”
সুতরাং করুণাময় চক্রবর্তীদের মত অহঙ্কারী অভিমানী জাতবেপারি পণ্ডিতস্মণ্যরা যে মহাপ্রভুর আদর্শ বিরোধী হয়ে নিরয়গামী শাস্ত্রবাক্য দিয়ে সমাজকে বিভ্রান্ত করবেন, এটাে খুবই ¯^াভাবিক ।
এরা দেখতে পায় না ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে কী লিখা আছে,
“অশ্বালম্ভং গবালম্ভং সন্ন্যাসং পলপৈতৃকম্ ।
দেবরেণ সুতোৎপাদন কলৌ পঞ্চ বিবর্জয়েৎ ।।”
অশ্বমেধ যজ্ঞ, গোমেধ যজ্ঞ, সন্ন্যাস, মাছ-মাংস দ্বারা পিতৃ-পুরুষের শ্রাদ্ধ, ও দেবর দ্বারা সন্তান উৎপাদন - এই পাঁচটি কর্ম কলিযুগে নিষেধ করা হয়েছে ।
করুণাময় চক্রবর্তী মহোদয়ের মত যারা শ্রাদ্ধবাসরে মাছ-মাংস আহার করেন, তারা নিশ্চয়ই বাকী কাজগুলিও করেন, তাদের পক্ষেই সম্ভব দেবর দ্বারা নিজের স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদনেরও ।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে সপ্তবিংশ অধ্যায়ে বলছেন, -
সকল দেশে সকল ব্রাহ্মণেরই তাল, মসুর ও মৎস্য পরিত্যাজ্য । ব্রাহ্মণ ইচ্ছাক্রমে মৎস্য ভোজন করলে ত্রিরাত্রি উপবাস ও প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধিলাভ করবেন ।
শ্রীমদ্ভাগবতে দেবর্ষি নারদ বলছেন -
“দেশে কালে চ সম্প্রাপ্তে মুন্যন্নং হরিদৈবতম্ ।
শ্রদ্ধয়া বিধিবৎ পাত্রে ন্যস্তং কামধুগক্ষয়ম্ ।।
দেবর্ষিপিতুভুতেভ্য আত্মনে সৃজনায় চ ।
অন্নং সংবিভজন্ পশ্যেৎ সর্ব্বং তৎ পুরুষাত্মকম্ ।।
ন দদ্যাদামিষং শ্রাদ্ধে ন চাদ্যাদবধর্মতত্ত¡বিৎ ।
মুন্যন্নৈঃ স্যাৎ পরা প্রীতির্যথা ন পশুহিংসন্না ।।”
- ( ভাঃ ৭/১১/৫-৭ )
শ্রাদ্ধোচিত দেশ এবং কাল প্রাপ্ত হলে নীবারাদি নিস্পাদিত-বিষ্ণুদৈবত অন্ন শ্রদ্ধা সহকারে যথাবিধি সুপাত্রে অর্পিত হলে তা ঈপ্সিত বস্তু প্রদান করে এবং অক্ষয় হয় । দেব, ঋষি, পিতৃগণ, তির্য্যগাদি জীব, ¯^য়ং ও ¯^জনাদির উদ্দেশ্যে যথাযথভাবে অন্ন বিভাগ করে দিয়ে সকলকেই নারায়ণ¯^রূপ দেখবে । ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি শ্রাদ্ধে আমিষ দ্রব্য দেবেন না এবং তা ভোজনও করবেন না । নিরামিষ নীবারাদির অন্নে শ্রাদ্ধীয় দেবতার যেরূপ প্রীতি জন্মে থাকে, পশুহিংসা অর্থাৎ আমিষ দ্বারা সেরূপ প্রীতি সাধিত হয় না ।
অবশ্য তামসিক ও আসুরিক ভাব সম্পন্ন লোকদের এসব কথা দৃষ্টিগোচর না হওয়াই ¯^াভাবিক ।
Comments
Post a Comment